সামরিক বাহিনীর আধুনিকায়ন-রাষ্ট্রীয় কর্তব্য

Sanchoy Biswas
এম এ মতিন
প্রকাশিত: ৮:২৫ অপরাহ্ন, ২৯ জুলাই ২০২৫ | আপডেট: ২:২৫ অপরাহ্ন, ২৯ জুলাই ২০২৫
ছবিঃ সংগৃহীত
ছবিঃ সংগৃহীত

সামরিক বাহিনী শুধু একটি রাষ্ট্রের প্রতিরক্ষার প্রতীক নয়—এটি একটি জাতির আত্মমর্যাদা, সার্বভৌমত্ব এবং আন্তর্জাতিক অবস্থান এবং আত্মপরিচয়ের সশস্ত্র রক্ষাকবচ। বাংলাদেশের জন্মভূমি রক্তাক্ত যুদ্ধের মধ্য দিয়ে স্বাধীনতা অর্জন করেছিল। সেই জাতির সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী এবং বিমানবাহিনীকে আধুনিক প্রযুক্তি ও আন্তর্জাতিক মানের সক্ষমতায় সুসজ্জিত করা এখন আর বিলাসিতা নয়—এটি রাষ্ট্রের অস্তিত্ব রক্ষার ন্যূনতম দায়িত্ব।

কিন্তু দুঃখজনকভাবে, বাংলাদেশ আজও তার সামরিক বাহিনীকে সময়োপযোগীভাবে আধুনিকায়ন করতে ব্যর্থ। যখন দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার অন্যান্য রাষ্ট্রগুলো মহাকাশ পর্যবেক্ষণ, ড্রোন যুদ্ধ, ও সাইবার প্রতিরক্ষা ব্যবস্থায় অগ্রসর হচ্ছে, আমরা তখনও দ্বিতীয় প্রজন্মের যুদ্ধাস্ত্রে সীমাবদ্ধ। এ প্রতিবেদন বিশ্লেষণ করবে কেন আমাদের এই দুর্বলতা, আমরা কোথায় পিছিয়ে এবং কীভাবে আমাদের বাহিনীকে আধুনিক করতে হবে।

আরও পড়ুন: গণ আকাঙ্ক্ষা বাস্তবায়নে হতাশার মুখোমুখি

বাংলাদেশের সামরিক কাঠামোঃ-এক নজরে

সেনাবাহিনী:

আরও পড়ুন: জম্মু-কাশ্মীর: আলাদা পরিচয় থেকে জাতীয় মূলধারায়

বাংলাদেশ সেনাবাহিনী বর্তমানে প্রায় ২.৫ লক্ষ সক্রিয় সেনা সদস্য এবং দশটি ডিভিশনের মাধ্যমে পরিচালিত হচ্ছে। অস্ত্রভাণ্ডারে রয়েছে পুরনো মডেলের চীনা ট্যাংক (T-59, T-69), কিছু MBT-2000 , কিছু আপডেটেড APC ও হেলিকপ্টার ও অল্পসংখ্যক আধুনিক কামান। তবে সাঁজোয়া যান ,রাতের যুদ্ধে সক্ষম সেন্সর, ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষা, এবং তথ্যভিত্তিক যুদ্ধে সক্ষমতা এখনও অপ্রতুল।

নৌবাহিনী:

“ফোর্সেস গোল ২০৩০” অনুযায়ী নৌবাহিনীর সম্প্রসারণ চললেও এখনো আমাদের হাতে রয়েছে মাত্র ২টি সাবমেরিন, কিছু Type-053H3 ৯টি ফ্রিগেট, এবং পুরনো ধরনের করভেট ও গানবোট । উপকূলীয় নজরদারি এবং সাবমেরিন যুদ্ধকৌশলে সীমাবদ্ধতা রয়েছে। আধুনিক নৌবিমান, ড্রোন, বা বিমানবাহী প্রতিরক্ষা রাডার সিস্টেম নেই।

বিমানবাহিনী:

বাংলাদেশ বিমানবাহিনীতে এখনো যুদ্ধবিমান হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে পুরনো F-7BGI ও MiG-29UB। Yak-130 প্রশিক্ষণ বিমান আছে, তবে ৪.৫ বা ৫ম প্রজন্মের কোনো যুদ্ধবিমান নেই। বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা দুর্বল, রাডার কাভারেজ অসম্পূর্ণ। AEW&C (Airborne Early Warning), AWACS, বা Long-Range SAM নেই। আমাদের আকাশ এখনও হুমকির মুখে।

আঞ্চলিক তুলনা: আমরা কোথায় দাঁড়িয়ে?

দেশযুদ্ধবিমানসাবমেরিনপ্রতিরক্ষা বাজেট (২০২৪) বিশেষত্ব
ভারতSu-30, Rafale১৭+ $৭৬ বিলিয়ননিজস্ব উৎপাদন, গবেষণা
পাকিস্তানJF-17, F-16১১+$১০ বিলিয়নচীনের সহায়তায় উন্নয়ন
মিয়ানমারYak-130, JF-17$২.৫ বিলিয়নরাশিয়া-চীন সরবরাহনির্ভর
বাংলাদেশF-7, MiG-29$৪.৭ বিলিয়ন

আমরা দেখতেই পাচ্ছি, প্রতিরক্ষা বাজেট ও সক্ষমতার দিক থেকে বাংলাদেশ এখনো অনেক পেছনে।

হুমকি কী কী?

মিয়ানমার সীমান্তে বারবার অনুপ্রবেশ ও গোলাগুলি

বঙ্গোপসাগরে ভারত ও চীনের প্রভাব বিস্তার প্রতিযোগিতা

রোহিঙ্গা সমস্যা ও আন্তঃসীমান্ত জঙ্গি তৎপরতা

সাইবার যুদ্ধ ও তথ্যযুদ্ধের বাস্তবতা

অভ্যন্তরীণ দুর্যোগে সেনা হস্তক্ষেপের প্রয়োজনীয়তা (বন্যা, ভূমিকম্প, সন্ত্রাস)

আধুনিকায়ন জরুরি কেন?

১. কৌশলগত সক্ষমতা বৃদ্ধি: যুদ্ধ শুরু হলে নয়, যুদ্ধের আগে প্রতিরোধ করতে হয়।

২. প্রতিরক্ষা শিল্প গড়ে তোলা: নির্ভরশীলতা কমিয়ে আত্মনির্ভরতা

৩. আন্তর্জাতিক শান্তিরক্ষায় সক্ষমতা: জাতিসংঘ মিশনে টিকে থাকতে হলে প্রযুক্তি ও প্রশিক্ষণ আধুনিক করতে হবে

৪. সুশৃঙ্খল সমাজে সামরিক শৃঙ্খলা: দুর্যোগ ব্যবস্থাপনাতেও বাহিনীর অবদান বাড়ছে

৫. সামরিক কূটনীতি: বাহিনীর মাধ্যমে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক দৃঢ হয় 

৬.ভূকৌশলগত অবস্থান: ভারত, চীন ও বঙ্গোপসাগরের মধ্যবর্তী অবস্থান আমাদেরকে একটি কৌশলগত হাবে পরিণত করেছে।

৭.প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও মানবিক সহায়তা: আধুনিক হেলিকপ্টার, পরিবহন বিমান ও উদ্ধার প্রযুক্তি অপরিহার্য

৮.সীমান্ত উত্তেজনা: মিয়ানমার ও ভারতের সঙ্গে সীমান্ত সংঘর্ষ সম্ভাব্য বাস্তবতা

৯.অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা ও জঙ্গিবাদ দমন: RAB ও সেনাবাহিনীকে ICT ও UAV ব্যবস্থায় আধুনিকায়ন জরুরি

আমরা কোথায় পিছিয়ে?

  • বাজেট অপ্রতুল (GDP-র ১.৫% মাত্র) বিশ্ব গড়: ~২.৪%)
  • দেশীয় প্রযুক্তি অভাব, দেশীয় প্রতিরক্ষা শিল্প কার্যত অনুন্নত ।বাংলাদেশে কোনো significant arms manufacturing facility নেই সব আমদানিনির্ভর
  •  চীন ও রাশিয়ার উপর অতিরিক্ত নির্ভরতা, পশ্চিমা প্রযুক্তির সীমিত ব্যবহার
  • রাজনৈতিক অগ্রাধিকার কম, দীর্ঘমেয়াদী প্রতিরক্ষা কৌশলের ঘাটতি
  • যুদ্ধ পরিস্থিতি বিশ্লেষণ সক্ষমতা দুর্বল (ISR systems নেই)
  • বাহিনীর যৌথ সক্ষমতা ও সমন্বয় ব্যবস্থা দুর্বল
  • আধুনিক যুদ্ধের উপযোগী কোনো কৌশলগত নীতি নির্ধারণ নেই যে,ডকট্রিন ২০–৩০ বছরের পরিকল্পনা নির্ধারণ করে
  • অফিসার প্রশিক্ষণে উন্নত দেশের মত স্ট্যান্ডার্ড নেই (বিশেষত বিমান ও নৌ খাতে)

আমাদের করণীয় কী?

১. তাত্ক্ষণিক পদক্ষেপ (১–৩ বছর):

  • ৩০–৫০ টি ৪.৫ প্রজন্মের যুদ্ধবিমান সংগ্রহ (Su-35, Rafale, Gripen)
  • NASAMS/HQ-9 টাইপের বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা স্থাপন
  • UAV স্কোয়াড্রন তৈরি, স্যাটেলাইট নজরদারিতে বিনিয়োগ
  • আধুনিক সাবমেরিন ও যুদ্ধজাহাজ সংগ্রহ
  • ইলেকট্রনিক যুদ্ধ (EW) এবং সাইবার কমান্ড ইউনিট স্থাপন

২. মধ্যমেয়াদী পরিকল্পনা (৩–৭ বছর):

  • দেশের ভেতরে প্রতিরক্ষা কারখানা (Joint venture with Turkey/China)
  • Cyber & Space Command গঠন
  • দেশীয় অস্ত্র উৎপাদন সক্ষমতা DRDO-এর আদলে সামরিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান
  • পেশাদার War College ও সামরিক বিশ্ববিদ্যালয়ের সম্প্রসারণ
  • বহুজাতিক প্রশিক্ষণ ও মহড়া (বিশেষ করে তুরস্ক ও ইউরোপীয় রাষ্ট্রের সাথে) 

৩. বাজেট বৃদ্ধি ও প্রশাসনিক সংস্কার:

  • প্রতিরক্ষা বাজেট ২০২৮ সালের মধ্যে GDP-র ২.৫% করতে হবে
  • প্রতিরক্ষা কমিটির মাধ্যমে স্বচ্ছতা নিশ্চিত

উপসংহার: সময় নেই, প্রস্তুতি দরকার

একটি স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশকে তার সামরিক বাহিনীর আধুনিকায়নের বিষয়ে আর গড়িমসি করা চলবে না। দক্ষিণ এশিয়ার ভূ-রাজনৈতিক বাস্তবতায় একটি শক্তিশালী, কৌশলগতভাবে প্রস্তুত এবং প্রযুক্তিনির্ভর বাহিনী না গড়ে তুললে আমরা শুধু পিছিয়ে পড়ব না—বরং ভবিষ্যতের হুমকির মুখে দাঁড়াবো সম্পূর্ণ অরক্ষিতভাবে। বাংলাদেশের অস্তিত্ব কেবল রাজনৈতিক সীমারেখায় সীমাবদ্ধ নয়—এটি সামরিক সক্ষমতার সুরক্ষায় নির্ভর করে। আমাদের অস্ত্র না থাকলে কূটনীতি ফলপ্রসূ হয় না। বাহিনী দুর্বল হলে সীমান্ত নিরাপত্তাহীন হয়ে পড়ে। আর আধুনিকায়ন না হলে বাহিনী কেবল ঐতিহাসিক গর্ব হয়ে থাকবে, ভবিষ্যতের রক্ষাকবচ নয়।

জাতির ভবিষ্যতের জন্য, বাহিনীর আধুনিকায়ন এখনই শুরু করতে হবে—পূর্ণতা নয়, প্রস্তুতির ভিত্তিতে। একটি আধুনিক সামরিক বাহিনী মানে শুধু যুদ্ধ নয়—এটি জাতীয় মর্যাদা, প্রতিরোধ ক্ষমতা, ও আত্মরক্ষার নিশ্চয়তা।

তথ্যসূত্র

Stockholm International Peace Research Institute (SIPRI)

IISS Military Balance 2024

Armed Forces Division of Bangladesh

Jane’s Defence Weekly

UN Peacekeeping Reports