প্রাথমিক–মাধ্যমিকের শিক্ষকদের কর্মবিরতিতে স্থগিত বার্ষিক পরীক্ষা, বিপর্যস্ত শিক্ষাপঞ্জি

Sanchoy Biswas
সফিকুল ইসলাম
প্রকাশিত: ৫:৪০ অপরাহ্ন, ০১ ডিসেম্বর ২০২৫ | আপডেট: ৫:৪৪ অপরাহ্ন, ০১ ডিসেম্বর ২০২৫
ছবিঃ সংগৃহীত
ছবিঃ সংগৃহীত
  • শিক্ষকদের কর্মবিরতিতে ক্ষোভ শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের
  • বন্ধ স্কুল, পরীক্ষা দিতে এসে ফিরে গেল শিক্ষার্থীরা
সরকারি প্রাথমিক ও মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকরা দেশজুড়ে পৃথকভাবে ৩ দফা ও ৪ দফা দাবি আদায়ে টানা কর্মবিরতি পালন করছেন। এতে রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে বার্ষিক পরীক্ষায় অংশ নিতে পারেনি শিক্ষার্থীরা। আবার অনেক জায়গায় স্কুল তালাবদ্ধ থাকায় গেট থেকেই ফিরে যেতে বাধ্য হয়েছে তাদের। নির্ধারিত সময়েও কেন্দ্রগুলোর দরজা না খোলা এবং শিক্ষকরা উপস্থিত না থাকায় হতাশা ও ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন শিক্ষার্থী ও অভিভাবকরা। একইসঙ্গে সারা দেশে পরীক্ষার সূচি ভেঙে পড়েছে। দীর্ঘমেয়াদি এই অচলাবস্থা শিক্ষাপঞ্জিকে নতুন করে বিপর্যস্ত করে তুলছে। এ অবস্থায় সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে শিক্ষার্থীরা, যারা সারা বছর প্রস্তুতি নিয়ে শেষ মুহূর্তে এসে পরীক্ষা নিয়ে অনিশ্চয়তায় পড়েছে।

প্রাথমিক শিক্ষক দাবি বাস্তবায়ন পরিষদের আহ্বায়ক মো. মাহবুবর রহমান বলেন, সারা দেশে লাগাতার কর্মবিরতি চলছে। সরকার সময়মতো দাবি পূরণ না করলে পরীক্ষাও বর্জন ছাড়া উপায় নেই। সংগঠনের আরেক আহ্বায়ক মোহাম্মদ শামছুদ্দিন মাসুদ বলেন, পে–কমিশনের সঙ্গে আমাদের দাবির সম্পর্ক নেই। সরকার চাইলে একদিনেই সমাধান সম্ভব—অর্থ বিভাগের সচিব নিজেই তা বলেছেন। এ অবস্থায় সরকার এখনো আলোচনার মাধ্যমে সমাধানের কথা বললেও শিক্ষক সংগঠনগুলো বলছে, প্রতিশ্রুতির চেয়ে বাস্তব পদক্ষেপ জরুরি।

তবে দেশের সরকারি প্রাথমিক ও মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের কর্মবিরতি ও পরীক্ষা বর্জনের কারণে শিক্ষার্থী ও অভিভাবকরা গভীর উদ্বেগে রয়েছেন। বছরের পুরো সময় ধরে প্রস্তুতি নেওয়া শিক্ষার্থীরা শেষ মুহূর্তে পরীক্ষা নিয়ে অনিশ্চয়তায় মানসিক চাপে পড়েছে। অভিভাবকরা বলছেন, দাবি থাকতেই পারে কিন্তু সেটার জন্য বছরের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মূল্যায়ন বন্ধ করা শিক্ষার্থীদের প্রতি অবিচার। এসব ঘটনায় সরকারি মাধ্যমিক ও সরকারি প্রাথমিকের প্রতি মানুষের আস্থা আরও কমবে বলে মত তাদের।

আরও পড়ুন: বাংলাদেশের বর্তমান শিক্ষা ব্যবস্থার মান: চ্যালেঞ্জ ও প্রয়োজনীয় সংস্কার এবং সেনাবাহিনীর অবদান

তাহমিনা তারান্নুম নামের ঢাকার এক অভিভাবক বলেন, শিক্ষকদের দাবিগুলো গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু বছরের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সময়ের মূল্যায়ন বন্ধ হওয়া শিক্ষার্থীর জন্য ক্ষতির। সরকারের উচিত অবিলম্বে শিক্ষক–সংগঠনের সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে সমাধান আনা, যাতে শিক্ষার্থীর প্রস্তুতি ও ভবিষ্যৎ ক্ষতিগ্রস্ত না হয়।

জহিরুল ইসলাম নামের আরেক অভিভাবক বলেন, শিক্ষকরা তাদের দাবি উপস্থাপন করতে পারেন, কিন্তু শিক্ষার্থীর শিক্ষা যেন পিছিয়ে না পড়ে। বার্ষিক পরীক্ষা ও নির্বাচনী পরীক্ষার সময়সূচি বজায় রাখতে প্রশাসনের দৃষ্টি জরুরি। শিক্ষার্থীর মানসিক চাপ কমানোর জন্য দ্রুত সমাধান দরকার।

আরও পড়ুন: প্রধান উপদেষ্টার কাছে জাতির আর্তনাদ !

শিক্ষার্থীদের স্বার্থে অগ্রাধিকার দেওয়ার আহ্বান জানিয়ে সামিন হোসেন নামের আরেক অভিভাবক বলেন, সন্তানরা পুরো বছর ধরে পরিশ্রম করেছে। শেষ মুহূর্তে পরীক্ষা বর্জনের কারণে তাদের মূল্যায়ন বন্ধ হলে হতাশা তৈরি হবে। আমরা আশা করি শিক্ষক ও সরকার যৌক্তিক সমাধান বের করবে এবং শিক্ষার্থীর স্বার্থকে অগ্রাধিকার দেবে।

এদিকে গতকাল সোমবার মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তরের (মাউশি) মাধ্যমিক শাখার পরিচালক অধ্যাপক খান মইনুদ্দিন আল মাহমুদ সোহেল বলেন, আমরা শিক্ষকদের দাবির গুরুত্ব বুঝতে পারছি। সেই সঙ্গে আমাদের মূল লক্ষ্য শিক্ষার্থীর স্বার্থকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দেওয়া। আমরা চাই চলমান বার্ষিক ও নির্বাচনী পরীক্ষা সুষ্ঠুভাবে অনুষ্ঠিত হোক, যাতে শিক্ষার্থীরা তাদের দীর্ঘ সময় ধরে নেওয়া প্রস্তুতির সুফল উপভোগ করতে পারে।

তিনি বলেন, শিক্ষার্থীর শিক্ষাজীবন, মানসিক স্থিতিশীলতা এবং প্রাপ্য মূল্যায়ন নিশ্চিত করা আমাদের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা ও বিদ্যালয়গুলোকে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নির্দেশেই আজকের নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। আমরা বিশ্বাস করি শিক্ষকরা একাডেমিক কার্যক্রম সচল রাখবেন এবং সকলের সহযোগিতায় শিক্ষার্থীর ভবিষ্যৎ উজ্জ্বল ও নিরাপদ হবে।

শিক্ষকরা বলছেন, দীর্ঘদিন ধরে বেতন–গ্রেড, পদোন্নতি, কর্মপরিবেশসহ নানা দাবি সরকারি পর্যায়ে উপেক্ষিত হচ্ছে। এসব দাবি না মানায় তারা কর্মবিরতিতে যেতে বাধ্য হয়েছেন। তারা বলছেন, চার দফা দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত তাদের আন্দোলন অব্যাহত থাকবে। কর্মবিরতি প্রত্যাহারের কোনো সিদ্ধান্ত এখনো হয়নি এবং দাবি পূরণ না হলে তারা চলমান কর্মসূচি চালিয়ে যাবেন।

তবে অভিভাবকরা বলেন, দাবি থাকতেই পারে কিন্তু সেটার জন্য বছরের সবচেয়ে জরুরি মূল্যায়ন বন্ধ করে দেওয়া কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। এতে শিক্ষার্থীদের ওপর যে মানসিক চাপ তৈরি হচ্ছে, তার দায় কেউ নিতে চাইছে না।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সরকারি প্রাথমিক ও মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকরা পৃথক দাবিতে আন্দোলন করলেও এখন পরিস্থিতি এমনভাবে জটিল হয়েছে যে দুই স্তরের শিক্ষকরাই কার্যত একই সময়ে কর্মবিরতি ও পরীক্ষা বর্জনের কর্মসূচিতে একাট্টা হয়ে পড়েছেন। একদিকে ৩ দফা দাবিতে সাড়ে তিন লাখ প্রাথমিক শিক্ষক টানা কর্মবিরতি চালিয়ে যাচ্ছেন। অন্যদিকে ৪ দফা দাবিতে সরকারি মাধ্যমিক শিক্ষকরাও সোমবার থেকে পূর্ণ দিবস কর্মবিরতির ঘোষণা দিয়েছেন।

দুই স্তরের শিক্ষকদের এই সমান্তরাল কর্মসূচির ফলে সারা দেশে বার্ষিক পরীক্ষা ও এসএসসির নির্বাচনী পরীক্ষা স্থগিত হওয়ার ঝুঁকি তৈরি হয়েছে। এতে বিপর্যস্ত হচ্ছে শিক্ষাপঞ্জি।

মাধ্যমিক শিক্ষকদের আন্দোলন গত সপ্তাহ থেকে তীব্র আকার ধারণ করে। ৯ম গ্রেডে এন্ট্রি, ক্যাডারভুক্তি, টাইমস্কেল, পদোন্নতি ও বকেয়া আর্থিক সুবিধা—এ চার দফা দাবিতে শিক্ষাভবন ঘেরাও করে টানা দুই দিনের অবস্থান কর্মসূচি পালন করেন বাংলাদেশ সরকারি মাধ্যমিক শিক্ষক সমিতির সদস্যরা।

সমাধান না পেয়ে তারা ঘোষণা দিয়েছেন, ১ ডিসেম্বর থেকে চলমান বার্ষিক পরীক্ষা বর্জন করবেন, এসএসসির নির্বাচনী পরীক্ষা নেবেন না এবং খাতা মূল্যায়নেও অংশ নেবেন না। তবে মাধ্যমিকের শিক্ষক নেতারা বলেছেন, দাবি নিয়ে বছরের পর বছর শুধু আশ্বাস পাওয়া গেছে, বাস্তবায়ন হয়নি। তাই বাধ্য হয়েই কঠোর কর্মসূচিতে যেতে হচ্ছে।

তারা বলেন, সরকার দাবিগুলো দ্রুত পূরণ করলে সাপ্তাহিক ছুটির দিনেও পরীক্ষা নিয়ে ডিসেম্বরের মধ্যেই ফল প্রকাশে প্রস্তুত তারা।

এদিকে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষকদের লাগাতার কর্মবিরতি নিয়ে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় আনুষ্ঠানিক প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে। তারা জানিয়েছে, তিন দফা দাবিতে চলমান কর্মবিরতি সরকারি চাকরি আইন ও সরকারি কর্মচারী (শৃঙ্খলা ও আপিল) বিধিমালার পরিপন্থী।

মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, সহকারী শিক্ষকদের বেতন–গ্রেডসহ তিন দফা দাবির বিষয়ে পে–কমিশনে কার্যক্রম চলমান রয়েছে এবং প্রয়োজনীয় কাগজপত্র অর্থ ও জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে।

অন্যদিকে, পরীক্ষা সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করতে ডিপিই কড়া নির্দেশনা দিয়েছে—নির্ধারিত সময়সূচি অনুযায়ী পরীক্ষার সব কার্যক্রম নিশ্চিত করতে হবে।

এছাড়া মাউশি থেকেও নির্দেশ দেওয়া হয়েছে, সরকারি–বেসরকারি মাধ্যমিক, নিম্ন মাধ্যমিক ও স্কুল–কলেজে ২০২৫ সালের বার্ষিক, নির্বাচনী ও জুনিয়র বৃত্তি পরীক্ষা নির্ধারিত সময়ে সম্পন্ন করতে হবে।