ডেটলাইন ২৮ অক্টোবর
জনমনে আতঙ্ক বাড়ছে

আসন্ন দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন ঘিরে সরকার ও বিরোধী দলের লাগাতার কর্মসূচিতে জনমনে নানা প্রশ্ন দেখা দিচ্ছে। আগামী জাতীয় নির্বাচনের আগে উভয়পক্ষের পাল্টাপাল্টি একের পর এক সমাবেশ, জনসভাসহ রাজনৈতিক কর্মকান্ডের পরিণতি কী হতে যাচ্ছে- তা ভেবেই সাধারণ মানুষের মধ্যে ভীতি আর আতঙ্ক দেখা দিয়েছে। বিশেষ করে আগামী ২৮ অক্টোবর রাজধানীর নয়াপল্টনে বিএনপি, গুলিস্তানে আওয়ামী লীগ ও মতিঝিল শাপলা চত্বরে জামায়াতে ইসলামীর সমাবেশ মষ পর্যন্ত শান্তিপূর্ণ থাকবে কিনা কৌতুহল তা নিয়েই।
এদিকে, দিন যত ঘনিয়ে আসছে ২৮ অক্টোবর ঘিরে জনমনে ততই বাড়ছে কৌতুহল আর আতঙ্ক। পাশাপাশি তিনটি দলের এমন সমাবেশ ঘিরে প্রশাসনের ভূমিকাই বা কী হতে পারে। যদিও হারানো ক্ষমতা ফিরে পেতে মরিয়া হয়ে উঠেছে বিএনপি। এবার প্রশাসনের অনুমতি না পেলেও সমাবেশ করার ঘোষণা দিয়েছে দলটি। অপরদিকে সমাবেশের নামে কোনো অরাজকতা করলে তাদের প্রতিহত করা হবে বলে জানিয়েছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। শুধু তাই নয়, একই দিনে তিনটি রাজনৈতিক দলের কর্মসূচি নিয়ে ছড়িয়েছে রাজনৈতিক উত্তেজনা। সম্প্রতি এমন পরিস্থিতিতে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের নিয়মিত ব্রিফিংয়েও প্রশ্ন উঠেছে ২৮ অক্টোবর নিয়ে।
আরও পড়ুন: চাঁদাবাজদের হুঁশিয়ারি আইজিপির
জানা যায়, ২০০৬ সালের ২৮ অক্টোবর ছিল বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের শেষ দিন। সেদিন রাজধানীতে ঘটেছিল রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ। এবারও সেই তারিখ নির্ধারণ করে রাজধানীতে ‘মহাযাত্রা’র ঘোষণা দিয়েছে বিএনপি। দলটির একাধিক সূত্র বলছে, সরকার হটানোর জন্য এটাই হবে তাদের ‘মরণকামড়’। সরকার পতনের এক দফা দাবিতে ২৮ অক্টোবরের এ সমাবেশে সারাদেশ থেকে নেতাকর্মী ও সমর্থকরা অংশ নেবে। তবে, বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, ২৮ অক্টোবর আমরা শুধু মহাযাত্রা করব। এজন্য ডিএমপি কমিশনার বরাবর চিঠিও দেওয়া হয়েছে।
২৮ অক্টোবর প্রসঙ্গে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায় বলেছেন, ‘সোজা কথা। আমরা সমাবেশ করব। যেখানে (নয়াপল্টনে) বসার কথা সেখানে না বসলে ঢাকার অলি-গলিতে ছড়িয়ে পড়ব, যার যা আছে তা নিয়ে বসে পড়ব। দেখবেন প্রত্যেক মানুষ ঘরের দরজা খুলে রাস্তায় নেমে আসবে। এখন টের পাচ্ছেন না তখন টের পাবেন।’ বুধবার দুপুরে বাংলাদেশ শিশু কল্যাণ পরিষদে জনতার অধিকার পার্টির (পিআরপি) উদ্যোগে ‘গণতন্ত্র ও ভোটাধিকার প্রতিষ্ঠায় বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার মুক্তি এবং নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে এক দফা দাবিতে’ আলোচনা সভায় এসব কথা বলেন তিনি।
আরও পড়ুন: রমজানে প্রতিদিন ৫ ঘণ্টা বন্ধ থাকবে সিএনজি স্টেশন
এদিকে আওয়ামী লীগের একাধিক নেতা জানিয়েছেন, ২৮ অক্টোবর বিএনপির কর্মসূচির দিকে দৃষ্টি রাখছে দলটি। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাওয়ার শঙ্কা থাকলে প্রতিরোধ গড়ে তোলার প্রস্তুতিও রয়েছে তাদের। এ ক্ষেত্রে রাজধানীর চার প্রবেশপথ যাত্রাবাড়ী, সূত্রাপুর, গাবতলী ও আবদুল্লাহপুর এলাকায় সতর্ক পাহারায় থেকে পরিস্থিতি সামাল দেয়ার চেষ্টা করবেন স্থানীয় নেতাকর্মীরা। সেই সঙ্গে ঢাকার ২০টি নির্বাচনী এলাকায় সকাল থেকে সতর্ক অবস্থান নেওয়া হবে বলেও জানানো হয়।
এ বিষয়ে বুধবার (২৫ অক্টোবর) ঢাকা মহানগর (ডিএমপি) পুলিশের কমিশনার হাবিবুর রহমান বলেছেন, রাজধানীতে সমাবেশ করার জন্য রাজনৈতিক দলগুলো আবেদন করেছে। জনসাধারণের জানমালের ঝুঁকি ও সার্বিক নিরাপত্তা ব্যবস্থা পর্যবেক্ষণ করে অনুমতি দেওয়ার চেষ্টা করা হবে। তিনি বলেন, রাজপথে জনসভা হলে জনগণের চলাচল বিঘ্নিত হয়। আমরা সবসময় চেষ্টা করি জনসাধারণের শান্তি ও স্বস্থি যেন অক্ষুন্ন থাকে। সেক্ষেত্রে আমাদের কিছু বিশ্লেষণ রয়েছে। সংশ্লিষ্ট থানার ওসি-এসি-ডিসিরা বাস্তবতা পরীক্ষা করে রিপোর্ট দিলে এরপর সমাবেশের অনুমতি দেওয়া না দেওয়ার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।
এছাড়া ২৮ অক্টোবর রাজনৈতিক কর্মসূচির নামে নাশকতার চেষ্টা করলে আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়ার কথা জানিয়েছে র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র্যাব)। বুধবার দুপুরে রাজধানীর কারওয়ান বাজার র্যাব মিডিয়া সেন্টারে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে র্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন বলেন, রাজনৈতিক দলগুলোর মহাসমাবেশকে কেন্দ্র করে ঢাকা শহরের প্রবেশমুখগুলোতে চেকপোস্ট বসাবে র্যাব। যাতে নাশকতার জন্য আগ্নেয়াস্ত্র বা বিস্ফোরক দ্রব্য নিয়ে কেউ সমাবেশে প্রবেশ করতে না পারে। একইভাবে গুরুত্বপূর্ণ স্থানেও বসবে চেকপোস্ট।
এদিকে, ২৮ অক্টোবর বিএনপির মহাযাত্রাকে কেন্দ্র করে ঢাকার প্রবেশ পথগুলো বন্ধের কোনো পরিকল্পনা সরকারের নেই বলে জানিয়েছেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল। বুধবার সচিবালয়ে সভা শেষে সাংবাদিকদের এ কথা জনান তিনি। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, ‘ঢাকায় প্রবেশ পথ আমরা কেন বন্ধ করব? ব্যবসায়ি ও চাকরিজীবীসহ বিভিন্ন কাজে লোকজন ঢাকায় আসেন। পদ্মাসেতু হওয়ার কারণে অফিস-আদালত করা লোকজনও ঢাকায় আসেন। কাজেই ঢাকার পথ কেন আমরা বন্ধ করবো? ঢাকার পথ আমরা বন্ধ করবো না, তারা যদি শান্তিপূর্ণভাবে নির্দিষ্ট স্থানে সমাবেশ করে চলে যায়, আমাদের কিছু করার নেই। আমরা সেখানে কোনো বাধা দেব না।’
তবে, বাংলাদেশে আসন্ন নির্বাচনে সব পক্ষের শান্তিপূর্ণ অংশগ্রহণের ওপর জোর দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। গত সোমবার রাতে নিয়মিত ব্রিফিংয়ে এক প্রশ্নের উত্তরে পররাষ্ট্র দপ্তরের মুখপাত্র ম্যাথিউ মিলার তার দেশের অবস্থান তুলে ধরে বলেন, ‘নির্বাচনকে কেন্দ্র করে বাংলাদেশের পরিস্থিতি আমরা নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করছি। সব পক্ষের শান্তিপূর্ণভাবে অংশগ্রহণ করতে পারাটা অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। ‘যার মধ্যে রয়েছে সরকারি কর্মকর্তা, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী, রাজনৈতিক দল, নির্বাচন কমিশন, গণমাধ্যম এবং অতি অবশ্যই ভোটাররা।’
এদিকে রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন, নির্বাচন যতই ঘনিয়ে আসছে দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি ততই অসহিষ্ণু হয়ে উঠছে। অতীতের মতো সংঘাত-সহিংসতা ও রক্তপাতের সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। সরকারি ও বিরোধী দলগুলো নিজেদের শক্তি পরীক্ষায় রাজপথ উত্তপ্ত করে তুলবে। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে কূটনীতিক নানা হিসাবনিকাশ। কেউ কেউ বলছেন, নির্বাচনের ঠিক আগে বিরোধীরা তাদের অবস্থান নিশ্চিত করতে চাইছে। এ লক্ষ্যে অক্টোবরের শেষ বেলায় এসে তারা রাজধানীতে বসে পড়ার পরিকল্পনা করছেন। হেফাজত স্টাইলে মতিঝিলের মতো রাজধানীর নিয়ন্ত্রণ নিতে মরিয়া থাকবে জামায়াতও। সমাবেশের অনুমতি না পেলে তারা বিএনপির সমাবেশে যুক্ত হতে পারে। তাদের সঙ্গে চরমোনাই পীরের ইসলামী আন্দোলন এবং খেলাফত মজলিসের নেতাকর্মীরাও যোগ দিতে পারেন। শেষতক কী ঘটে সেটাই এখন দেখার বিষয়।