কাশিয়ানীতে অবৈধ ড্রেজার দিয়ে বালু উত্তোলনের মহাযজ্ঞ
গোপালগঞ্জের কাশিয়ানীতে রাতের অন্ধকারে ভয়াবহভাবে বেড়ে উঠেছে অবৈধ ড্রেজার সিন্ডিকেটের দৌরাত্ম্য। উপজেলার বিভিন্ন ইউনিয়নের গ্রামে গ্রামে গভীর রাতে ড্রেজার বসিয়ে নির্বিচারে বালু উত্তোলন করে অবৈধ ড্রেজার চক্র। প্রশাসনের নীরবতা ও রহস্যজনক উদাসীনতার সুযোগে প্রতিনিয়ত ধংস হচ্ছে ফসলি জমি, ধসে পড়ছে খাল–বিল, ভেঙে যাচ্ছে গ্রামীণ সড়ক। এ যেন চোখের সামনে এক স্থায়ী পরিবেশবিপর্যয়ের অশনি সংকেত। রাতের পর রাত চলছে অবৈধ ড্রেজার।
স্থানীয়রা জানান, সন্ধ্যা ৭টা থেকে ভোর পর্যন্ত চলছে ড্রেজার দিয়ে বালু উত্তোলনের মহাযজ্ঞ। উত্তোলনের ফলে ফসলি জমিতে বড় বড় গভীর গর্ত সৃষ্টি হয়েছে, কোথাও মাটি সরে গিয়ে জমি ভেঙে পড়ছে। একজন বয়স্ক কৃষক ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন—“আমার ৪০ শতক জমির অর্ধেকটাই ভেঙে গেছে। পানি নামছে না, চাষ করতে পারছি না। কার কাছে বিচার চাই?” বিল–খাল–জলাধারও রেহাই পাচ্ছে না, শুধু বর্ষার সময় নয় শুকনো মৌসুমেও খাল–বিল শুকিয়ে গেলে অবৈধ চক্র এগুলোকে তাদের ‘সোনার খনি’ মনে করে। খাল, জলাধার, ফসলি জমিতে ড্রেজার বসিয়ে গভীরভাবে কাটা হচ্ছে। এতে সেচব্যবস্থা বিঘ্নিত হচ্ছে, মাছের প্রজনন ধ্বংস হচ্ছে এবং বর্ষায় বন্যার ঝুঁকি বাড়ছে।
আরও পড়ুন: চাঁপাইনবাবগঞ্জ সীমান্তে ২ ভারতীয় গরু চোরাকারবারী আটক
উপজেলার সাজাইল ইউনিয়নের কাসেম মোল্লা নামে এক কৃষক কাঁপা কণ্ঠে বলেন—“আমরা আইন মানি, সরকারের কথাও মানি। কিন্তু এই অবৈধ ড্রেজারের কাছে সবাই হার মানছে। আমাদের বাঁচান।” অবৈধ বালু উত্তোলন আজ আর শুধু পরিবেশের ক্ষতির বিষয় নয়; এটি পরিণত হয়েছে প্রশাসনিক দায়হীনতা, সিন্ডিকেটের প্রভাবে সাধারণ মানুষের নিরাপত্তা ও জীবিকা নিয়ে মারাত্মক সংকটে।
একাধিক কৃষকরা জানান—“খালে পানি আটকে আছে, ড্রেজারের কারণে প্রাকৃতিক প্রবাহ বন্ধ। পুরো মৌসুমে ফসল তোলার আগেই ক্ষেত শুকিয়ে যাচ্ছে।” নষ্ট হচ্ছে গ্রামের জীবন–জীবিকা। ড্রেজার দিয়ে বালু উত্তোলনের ফলে—গ্রামীণ কাঁচা ও পাকা রাস্তা ভেঙে যাচ্ছে, বাঁধ ও বেড়া ধসে পড়ছে। স্কুল–মসজিদের সামনের রাস্তা কাদা–গর্তে পরিণত হচ্ছে। শিক্ষার্থী ও রোগীদের চলাচলে চরম দুর্ভোগ সৃষ্টি হচ্ছে।
আরও পড়ুন: সাবেক রাষ্ট্রপতির সড়কে টেম্পু ছাড়া কিছুই চলে না: ফাওজুল কবির
স্থানীয় এক স্কুলশিক্ষক বলেন, “বৃষ্টির দিনে তো এসব রাস্তায় হাঁটাই বিপজ্জনক। ছাত্রছাত্রীরা প্রতিদিন জীবনের ঝুঁকি নিয়ে স্কুলে আসে।” আইন আছে, তদারকি নেই। বালু ব্যবস্থাপনা আইন অনুযায়ী—
নদী, খাল, জলাধার, ফসলি জমিতে অনুমোদন ছাড়া ড্রেজার বসানো সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। আইনে জরিমানা, কারাদণ্ড ও ড্রেজার জব্দের কঠোর বিধান থাকলেও কাশিয়ানীতে তা কার্যকর হতে দেখা যাচ্ছে না।
স্থানীয়দের দাবি—কিছু প্রভাবশালী ব্যক্তি, অবৈধ ড্রেজার ব্যবসায়ী, জমির দালাল, অবৈধ বালু ব্যবসায়ী, ঠিকাদারি চক্র একযোগে পরিচালনা করছে এ বালু উত্তোলন। তারা নাকি রাতের বেলায় পাহারার লোক রাখে, বহিরাগতদের প্রবেশে বাঁধা দেয়। ক্ষতিগ্রস্ত রাস্তায় দুর্ভোগ চরমে ইউনিয়ন সড়ক, পাকা ব্রিজের মাথা, কবরস্থান–স্কুলের রাস্তা সম্পূর্ণ খানা-খন্দে পরিণত হয়ে পড়েছে। এ বিষয়ে একজন ভ্যানচালক বলেন—“রাস্তা এমন ভাঙা যে ভ্যান নিয়ে গেলে যাত্রী নামিয়ে দিতে হয়।”
স্থানীয়দের অভিযোগ—অভিযান দেখানোর জন্য কয়েকবার ড্রেজার পাইপ কেটে দেওয়া হলেও কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই তা আবার বসিয়ে দেওয়া হয়। কারা এই চক্রের পেছনে—সেই প্রশ্ন ঘুরে বেড়াচ্ছে উপজেলাজুড়ে। প্রশাসনের ভূমিকা নিয়ে অনেক গ্রামবাসী বলেন, প্রশাসনের নীরবতা অবৈধ কার্যক্রমকে আরও বেপরোয়া করছে। “দিনে কেউ আসে না, রাতে ড্রেজার চলে। আমরা ফোন দিলে বলে পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে। কিন্তু কখনোই আসে না।” স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরাও প্রকাশ্যে স্বীকার করছেন, বালু উত্তোলনের কারণে গ্রামজুড়ে পরিবেশ ও কৃষি ক্ষতিগ্রস্ত হলেও প্রশাসনিক নজরদারি যথেষ্ট নয়।
পরিবেশ বিশেষজ্ঞরা বলছেন—অতিরিক্ত বালু উত্তোলনে মাটির স্তর নষ্ট হয়ে দীর্ঘমেয়াদে কৃষি উৎপাদন কমে যেতে পারে, মাটির জলধারণক্ষমতা নষ্ট হলে এলাকায় তীব্র খরা দেখা দিতে পারে, খালের গতি রোধ হলে বর্ষায় জলাবদ্ধতা তৈরি হবে, ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নিচে নেমে যাবে। এছাড়াও একজন পরিবেশ গবেষক মন্তব্য করেন—“এভাবে চলতে থাকলে কয়েক বছরের মধ্যেই কাশিয়ানীর বেশ কিছু এলাকা কৃষির অনুপযোগী হয়ে পড়বে।” যথাসময়ে কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়া না হলে পুরো এলাকায় সৃষ্টি হবে এক দীর্ঘমেয়াদি পরিবেশ বিপর্যয়, যার মূল্য দিতে হবে কৃষি, জনজীবন ও গ্রামীণ অবকাঠামোকে।
অবৈধ বালু উত্তোলনের কারণে প্রতিবাদ করলেই ভয়ভীতি প্রদর্শন, মামলা দেয়ার হুমকি—এমন অভিযোগও রয়েছে। স্থানীয়দের একটাই দাবি—অবিলম্বে অভিযান, সব ড্রেজার অপসারণ, জড়িতদের বিরুদ্ধে মামলা, ক্ষতিগ্রস্ত জমি ও রাস্তা সংস্কার, রাতের বেলা নিয়মিত টহল, প্রশাসনের স্বচ্ছ তদারকি।





