নারায়ণগঞ্জে ৫ শত বছরের পুরনো আধ্যাত্মিক অলৌকিক কদম রসুল দরগাহ

Sanchoy Biswas
ইউসুফ আলী প্রধান, নারায়ণগঞ্জ
প্রকাশিত: ৫:৫৬ অপরাহ্ন, ২০ অগাস্ট ২০২৫ | আপডেট: ১১:২৮ অপরাহ্ন, ২০ অগাস্ট ২০২৫
ছবিঃ সংগৃহীত
ছবিঃ সংগৃহীত

কদম রসুল বলতে আমাদের প্রিয় নবী হযরত মুহাম্মদ (সঃ)-এর পায়ের ছাপকে বোঝায়। অন্যভাবে, কদম রসুল হলো একটি পবিত্র স্থান যেখানে নবী মুহাম্মদ (সঃ)-এর পদচিহ্ন সংবলিত পাথরখণ্ড সংরক্ষিত থাকে।

অনেকের বিশ্বাস, হযরত মুহাম্মদ (সঃ) মিরাজের রাতে বোরাকে ওঠার পূর্বে কিছু পাথরে তাঁর পায়ের ছাপ অঙ্কিত হয়। পরে সাহাবীগণ এগুলো সংরক্ষণ করেন। তখনকার যুগে মক্কা ফেরত অনেকেই এ ধরনের পদচিহ্ন যুক্ত পাথরখণ্ড শ্রদ্ধার সঙ্গে বিভিন্ন সৌধে, বিশেষ করে মসজিদের অভ্যন্তরে সংরক্ষণ করতেন।

আরও পড়ুন: ফের খুলে দেওয়া হলো কাপ্তাই বাঁধের ১৬টি জলকপাট

মাসুম খান কাবুলী নামক এক রাজা ১৫৮০ খ্রিস্টাব্দে আরব বণিকদের নিকট হতে বহু অর্থের বিনিময়ে এই মহামূল্যবান পাথরটি ক্রয় করেন এবং এটি ঐ স্থানে প্রতিষ্ঠা করেন। সুবাদার ইসলাম খান, মুঘল সম্রাট শাহজাহান সহ আরও অনেক আমির-ওমরারা এ স্থান দর্শন করেন। যা নারায়ণগঞ্জ জেলার বন্দর থানাধীন বর্তমান নাসিক সিটি কর্পোরেশন ২৩ নম্বর ওয়ার্ডের নবীগঞ্জ কদম রসুল দরগাহ নামে সারাদেশে পরিচিত।

এই সুপরিচিত ঐতিহাসিক কদম রসুল দরগাহ নারায়ণগঞ্জ শহরের পাশ দিয়ে প্রবাহিত শীতলক্ষ্যা নদীর পূর্ব পাড়ে, গ্র্যান্ড ট্রাঙ্ক রোডের দক্ষিণে নবীগঞ্জ এলাকায় অবস্থিত।

আরও পড়ুন: গাইবান্ধায় তিস্তা নদীর উপর মওলানা ভাসানী সেতু উদ্বোধন

জানা যায়, ১৭ শতকের শুরুর দিকে ‘বাহারিস্থান-ই-গায়েবী’ গ্রন্থ অনুযায়ী, মুঘল সম্রাট আকবরের বিপক্ষে বিদ্রোহ ঘোষণাকারী আফগান নেতা মাসুম খান কাবুলী ছিলেন। তিনি ওই পাথর ১৫৮০ খ্রিস্টাব্দে আরব বণিকদের নিকট থেকে ক্রয় করেন এবং এখানে প্রতিষ্ঠা করেন। সুবাদার ইসলাম খান, মুঘল সম্রাট শাহজাহানসহ অনেক আমির-ওমরা এ স্থান দর্শন করেন। সুলতান শুজা এই দরগাহর জন্য ৮০ বিঘা জমি দান করেন। ঈশা খাঁর প্রপৌত্র দেওয়ান মনোয়ার খাঁ এখানে একটি ইমারত নির্মাণ করেন, যা পরবর্তীতে বিলীন হয়ে যায়। ঢাকার জমিদার গোলাম নবী পরে (১৭৭৭–১৭৭৮ খ্রিস্টাব্দে, ১১৯১ হিজরিতে) এক গম্বুজ বিশিষ্ট এই দরগাহ নির্মাণ করে পাথরখণ্ডটি স্থাপন করেন। তাঁর তৃতীয় পুত্র গোলাম মোহাম্মদ ১৮১৪ খ্রিস্টাব্দে পশ্চিম দিকের দোতলা তোরণটি নির্মাণ করেন।

সরেজমিনে দেখা যায়, কদম রসুল দরগাহটি ভূমি থেকে ৩০ ফিট উঁচু টিলার ওপর অবস্থিত। দরগাহের সামনে একটি কারুকাজখচিত সুউচ্চ দোতলা তোরণ আছে, যা মসজিদ বা মাজারের আদলে নির্মিত। ভিতরে প্রবেশ করতেই বামে একটি মসজিদ রয়েছে, যেখানে মহিলাদের নামাজের ব্যবস্থা রয়েছে। ডানদিকে কিছু পাকা কবর আছে, জনশ্রুতি অনুযায়ী এগুলো কদম রসুল দরগাহর প্রতিষ্ঠাতা মাসুম খান কাবুলীর বংশধরদের কবর। এছাড়া মাঝ বরাবর গোলাম নবী নির্মিত এক গম্বুজ বিশিষ্ট পবিত্র সৌধটিতে মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সঃ)-এর কদম মুবারক পাথরটি সংরক্ষিত আছে বলে জানা যায়। সাধারণত পবিত্র পাথরটি একটি ধাতব পাত্রে গোলাপ জলে ডুবিয়ে রাখা হয়। পাথরের গায়ে পায়ের আঙ্গুলের স্পষ্ট ছাপ দেখা যায়।

তিনি আরও জানান, কদম রসুল দরগাহ শরীফ ৫ শত বছরের পুরনো আধ্যাত্মিক অলৌকিক কেন্দ্র। জনশ্রুতি আছে, এটি গায়েবীভাবে এক রাতে মাটির নিচ থেকে উঠেছিল, যা আল্লাহর অশেষ মেহেরবানীর ফল। তবে স্থানীয় মুসলিমরা এটিকে স্বীকার করেন না।

অন্যান্য অনেক জায়গায় পদচিহ্ন ভিন্ন আকারের দেখা যায়, যেখানে একজন মানুষের পায়ের ছাপ একই হওয়ার কথা। কদম রসুল প্রচলিতভাবে নবী করিম মুহাম্মদ (সঃ)-এর পায়ের ছাপ, যদিও মূল ইসলাম ধর্মে এর কোনো স্বীকৃতি নেই। এজন্য ইসলাম ধর্মের উৎপত্তিস্থল মধ্যপ্রাচ্যে এ ধরনের কোনো নিদর্শন সংরক্ষিত নেই এবং ধর্মীয় ভাবেও চর্চিত নয়। প্রশ্ন জাগে, তাহলে কেন, কীভাবে এবং কোন প্রয়োজনে এই কদম রসুল ধারণা ভারতবর্ষে জন্ম নেয়—বিশেষ করে নবী করিমের পরলোক গমনের কয়েকশ বছর পরে? ভারতের উপমহাদেশে ইসলাম ধর্মের আগমন প্রথমে বণিকদের সাথে আসা সুফী সাধকদের মাধ্যমে, পরে আফগান, তুর্কী, পার্সীয় ও মুঘল শাসকদের নেতৃত্বে ঘটে। আমরা জানি, বৌদ্ধ ধর্মের প্রারম্ভিক যুগে এখানে মূর্তিবিহীন ধর্ম ছিল; পরবর্তীতে মূর্তিপূজা প্রবেশ করে। বৌদ্ধ উপকথা অনুযায়ী গৌতম বুদ্ধ শ্রীলংকায় "শ্রী পদ" নামে একটি পাহাড়ে পায়ের ছাপ রেখে যান, যা হিন্দুরা শিব এবং মুসলিমরা আদম (আ:)-এর বলে বিশ্বাস করেন। এই প্রাচীন উপাসনার রীতি উপমহাদেশে বহু যুগ ধরে ছিল।

ঘটনাচক্রে, সনাতন ও বৌদ্ধ অনুসারীরা ইসলামে অনুরক্ত হলেও, ইসলামে মূর্তিপূজা শিরক (আমানত) হিসেবে নিষিদ্ধ। তবুও, ভারতীয় মানুষের দীর্ঘদিনের মনস্তাত্ত্বিক প্রভাব থেকে হয়তো এই কদম রসুলের উদ্ভব হয়। মানুষ মনোবাসনা পূরণে কদম রসুলে মানত করতে থাকেন।

প্রতি বছর আরবি রবিউল আউয়াল মাসের ১ থেকে ৪ তারিখ চারদিনব্যাপী এখানে মেলা অনুষ্ঠিত হয়। ধর্মবিশ্বাস যাই হোক, কদম রসুল দরগা একটি পুরনো ও ঐতিহাসিক স্থান যা দেখতে দূর-দূরান্ত থেকে ভক্ত ও দর্শনার্থী সমাগম ঘটে।

এ বিষয়ে জানতে দরগাহর খাদেম আলী নূর জানান, “আমার বাবা-দাদারা এখানকার খাদেম ছিল, এবং আমরা এখন খাদেম। শুনেছি, নূর মুহাম্মদ আরবী নামে একজন এখানে কদম নিয়ে আসেন। তখনকার রাজা শাহা শুজা তাকে ৮০ বিঘা জমি ওয়াকফ করে দেন। সেই থেকেই দেশ-বিদেশ থেকে মানুষ আসা শুরু করেন।”