দলবাজের শেকল ভেঙ্গে পেশাদার আমলাতন্ত্র গড়তে সংস্কারের রূপরেখা

ভূমিকা:
বাংলাদেশের প্রশাসন আজ রাজনৈতিক আনুগত্য, ঘুষ বাণিজ্য ও অবৈধ অর্থের ছায়ায় বন্দী। যোগ্যতা—দক্ষতা-সততার জায়গায় উঠে এসেছে “কার পাশে, কার পকেটে”—এই বিকৃত মানদণ্ড। এর ফলে রাষ্ট্রযন্ত্র জনস্বার্থ থেকে সরে গিয়ে ব্যক্তিস্বার্থ, দলীয় লুণ্ঠন ও প্রাতিষ্ঠানিক দুর্নীতির কারখানায় পরিণত হয়েছে। এই প্রবন্ধে দৃশ্যমান তথ্য-উপাত্তে দেখাবো, কোথায় কীভাবে পচন ধরেছে, বর্তমান আইনি কাঠামোয় কী লেখা আছে, বাস্তবে কী হচ্ছে, এবং কীভাবে শেকল ভাঙা যায়—একটি কার্যকর সংস্কার খসড়াসহ।
আরও পড়ুন: বাংলাদেশের বাজার পরিস্থিতি ও ভবিষ্যতের চ্যালেঞ্জ
১) দুর্নীতির থার্মোমিটার: বাংলাদেশ কোথায় দাঁড়িয়ে?
ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল (CPI 2024):
আরও পড়ুন: গণ আকাঙ্ক্ষা বাস্তবায়নে হতাশার মুখোমুখি
বাংলাদেশ ১৮০ দেশের মধ্যে ১৫১তম, স্কোর ২৩/১০০—গত বছরের তুলনায়ও অবনতি, গত ১৩ বছরের মধ্যে সবচেয়ে নিচু স্কোর।
TIB জাতীয় গৃহস্থালি জরিপ ২০২৩:
সেবা নিতে গিয়ে ৭০.৯% পরিবারের দুর্নীতির অভিজ্ঞতা; ৫০.৮% পরিবারকে ঘুষ বা অবৈধ অর্থ দিতে হয়েছে। মোট ঘুষ লেনদেন আনুমানিক ১০,৯০২.৩ কোটি টাকা—GDP-র প্রায় ০.২২%।
সবচেয়ে দূষিত খাত: পাসপোর্ট, BRTA, আইনশৃঙ্খলা ও বিচার।
TIB জরিপ ২০২১ (তুলনা):
গড়ে প্রতি পরিবার ৬,৬৩৬ টাকা ঘুষ দিয়েছে; মোট ঘুষ ১০,৮৩০ কোটি টাকা ; ৭২% বলেছে, ঘুষ না দিলে সেবা মেলে না—দুর্নীতি প্রাতিষ্ঠানিক।
বার্তা স্পষ্ট: দুর্নীতি ব্যতিক্রম নয়, নিয়ম—আর এই নিয়ম তৈরি করে দলবাজ প্রশাসন।
২) “কাগজে-কলমে” পদোন্নতির মাপকাঠি, আর মাঠে যা ঘটে
আইনি কাঠামো কী বলে?
সরকারি পদোন্নতিতে মেধা-দক্ষতা–সিনিয়রিটি (merit, efficiency and seniority)—এটাই Government Servants (Promotion) Rules, 2002-এর ভিত্তি; উচ্চপদে (অ্যাডিশনাল সেক্রেটারি/সেক্রেটারি) পদোন্নতিতে পদ-স্বভাব/গুরুত্ব বিবেচ্য—হাইকোর্টের ব্যাখ্যাতেও তা-ই।
বাস্তবতা কী?
গবেষণা ও পর্যবেক্ষণে বছরের পর বছর দলীয় আনুগত্যকে পদোন্নতির প্রধান শর্তে পরিণত করা, অযোগ্যদের উন্নীত করা, আর যোগ্য—সৎ কর্মকর্তাকে OSD/সাইডলাইনে রাখা—এসবকে “স্বাভাবিক প্রক্রিয়া” বানানো হয়েছে।
ফল: সিদ্ধান্ত-প্রক্রিয়া ধীর, নীতিনির্ধারণে ভয়, ফাইল চলে “ফোনকল-লবিং-মহল” দিয়ে; জনসেবা হয় “ফি—অফিসিয়াল + আনঅফিসিয়াল”।
৩) নিয়োগ ও পরীক্ষা: প্রবেশদ্বারই যদি ফাঁস
PSC/নিয়োগ প্রশ্নফাঁস কেলেঙ্কারি:
অন্তত ৩০টি নিয়োগ পরীক্ষা (BCSসহ) বহু বছর ধরে ফাঁস—এই চক্রে PSC-এর কর্মকর্তাও জড়িত; ভেতরের স্বীকারোক্তি-আটক-ব্যাংক লেনদেন—সবই নথিবদ্ধ।
প্রভাব: যোগ্যতার বদলে টাকার লোক ঢুকে পড়ে; পরে তারা ঘুষ দিয়ে যা তুলেছে, চাকরিতে বসে তা “রেকভার” করতে চায়—দুর্নীতির চক্র এভাবেই নিজেকে পুনরুৎপাদন করে।
৪) সেবা খাতে দুর্নীতির “হটস্পট” ও খরচ—অর্থনীতি
পাসপোর্ট: ২০২৩-এ সবচেয়ে দুর্নীতিগ্রস্ত খাত; ঘুষ দিতে হয়েছে ৭৪.৮%+ সেবাপ্রার্থীকে।
BRTA: ২০২৩-এ ৮৫%+ পরিবারের দুর্নীতির অভিজ্ঞতা; লাইসেন্স-স্মার্টকার্ড—ফিটনেসে মধ্যস্বত্বভোগী-ব্রোকারের রাজত্ব।
আইনশৃঙ্খলা বাহিনী: ২০২৩-এ ৭৪.৫% পরিবারের দুর্নীতির অভিজ্ঞতা।
বিচারখাতে গড় ঘুষ সর্বোচ্চ—প্রতি পরিবার ~৩০,৯৭২ টাকা (জরিপভিত্তিক)।
এই “ঘুষ-GDP” কেবল অর্থনৈতিক ক্ষতি নয়; এটি আইনের শাসন, সামাজিক আস্থা ও রাষ্ট্রীয় বৈধতা—সব কিছুকে কুড়ে কুড়ে খাচ্ছে।
১. খাতভিত্তিক দুর্নীতি (২০২৩): পাসপোর্ট, BRTA, পুলিশ ও বিচারখাত—যেখানে কত শতাংশ পরিবার দুর্নীতির শিকার।
২. গড় ঘুষের পরিমাণ (BDT): প্রত্যেক খাতে পরিবারপ্রতি কত টাকা ঘুষ দিতে হয়েছে তার চিত্র।
এখানে দুটি টাইমলাইন চার্ট তৈরি হলো:
1. CPI স্কোর (২০১২–২০২৪): গত এক দশকে বাংলাদেশ দুর্নীতির সূচকে কখনোই ৩০-এর ওপরে উঠতে পারেনি; ২০২৪-এ নেমেছে সর্বনিম্ন ২৩-এ।
2. CPI র্যাঙ্ক (২০১২–২০২৪): বাংলাদেশ ধারাবাহিকভাবে নিচের দিকেই অবস্থান করেছে; ২০২৪-এ পৌঁছেছে ১৫১তম স্থানে (১৮০ দেশের মধ্যে)।
৫) পারফরম্যান্স ম্যানেজমেন্ট (APA): কাগজের বাঘ?
সরকার ২০১৪–১৫ থেকে Annual Performance Agreement (APA) চালু করেছে—উদ্দেশ্য জবাবদিহি বাড়ানো। কিন্তু বাস্তবে ডেটার বিশ্বাসযোগ্যতা, পোস্ট-ট্রেনিং মূল্যায়ন, মাঠ পর্যায়ে প্রয়োগ—সবখানেই ফাঁকফোকর রয়ে গেছে; ফলে APA অনেক জায়গায় টিক-মার্কিং এক্সারসাইজ-এ নেমে এসেছে।
৬) কেন দলবাজি–ঘুষ–অযোগ্যতা পরস্পরকে খাওয়ায়?
রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতা → নিয়োগ/পদোন্নতিতে পক্ষপাত → অযোগ্যতার প্রাতিষ্ঠানিকীকরণ।
প্রবেশেই প্রশ্নফাঁস/ঘুষ → পদ পাওয়ার পর রেন্ট-সিকিং ফেরত আদায়।
দুর্বল পারফরম্যান্স মেট্রিক্স → প্রকৃত KPI-এর বদলে “ম্যানেজড” রিপোর্ট কারচুপি।
বিচার ও আইনশৃঙ্খলায় দুর্নীতি → শাস্তিহীনতা → দুর্নীতির কস্ট–বেনিফিটে লাভ বাড়ে।
(উপরের প্রতিটি ধাপের পক্ষে আগের অনুচ্ছেদের তথ্যসূত্র দেখুন।)
৭) কীভাবে শেকল ভাঙা যায়: ১২ দফা নীতিমালা:
ক) পদোন্নতি-পোস্টিং ডিপলিটিসাইজেশন:
Promotion Rules, 2002 কঠোরভাবে প্রয়োগ—SSB/Promotion Board-এ স্বাধীন সদস্য, সভার মিনিটস ও স্কোরকার্ড (নাম গোপন রেখে) প্রকাশ।
Merit-cum-Seniority বাস্তবায়নে ওজনযুক্ত স্কোরিং:
(i) একাডেমিক/প্রশিক্ষণ,
(ii) শেষ ৫ বছরের স্বতন্ত্রভাবে যাচাইকৃত APA-KPI,
(iii) মাঠ-ফল (citizen outcomes),
(iv) সততা সূচক (স্বচ্ছ সম্পদ বিবরণী, হুইসেলব্লোয়ার অভিযোগ না থাকা)।
OSD-কে শাস্তিমূলক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার নিষিদ্ধ; OSD-এ থাকলে কারণ লিখিত প্রকাশ ও সর্বোচ্চ ৬০ দিন সীমা।
খ) নিয়োগ ও পরীক্ষা শুদ্ধিকরণ:
PSC-তে ডিজিটাল কোল্ড-চেইন: প্রশ্ন তৈরি–মুদ্রণ–বিতরণে end-to-end এনক্রিপশন, হোয়াইটলিস্টেড প্রিন্টিং, হলে RF-শিল্ডিং ও স্মার্ট নজরদারি; লঙ্ঘনে অবিলম্বে বাতিল–পুনঃপরীক্ষা এবং আজীবন সরকারি চাকরিতে অযোগ্যতা।
Question Bank Forensics + Bank Transaction Analytics—প্রশ্নফাঁস চক্রের অর্থপ্রবাহ ট্র্যাক করে সম্পদ বাজেয়াপ্ত।
গ) ঘুষ-অর্থনীতির জোয়ার ভাঙা:
হাই-রিস্ক সেক্টর (পাসপোর্ট, BRTA, থানা, ভূমি, বিচার)-এ “ক্যাশলেস—কন্ট্যাক্টলেস” সেবা: টোকেনাইজড ফি, কিউ-ম্যানেজমেন্ট, সার্ভিস-টাইম SLA অটোমেশন—SLA ভাঙলে স্বয়ংক্রিয় ফি-রিফান্ড + পেনাল্টি।
Citizen Audit: ত্রৈমাসিকভাবে র্যান্ডম কল-ব্যাক সার্ভে; সেক্টরভেদে Bribe-to-Service Ratio ড্যাশবোর্ড পাবলিক।
(পদ্ধতি: TIB জরিপের মেথডোলজি অনুকরণে সরকারি পর্যায়ে স্থায়ী টেলি-প্যানেল।)
এন্ট্রি-লেভেল বেতন ও মাঠভাতা রিব্যালেন্স—“টেক-হোম” যথাযথ না হলে ইনটেগ্রিটি লস বাড়ে (কমপ্যারেটিভ রিসার্চে প্রমাণিত)।
ঘ) APA-কে “কাগজের বাঘ” থেকে বাস্তব বাঘ:
APA-KPI-তে ফলাফলভিত্তিক সূচক (outcome KPIs): যেমন—পাসপোর্টে ডেলিভারি-টাইম, BRTA-তে লাইন-টাইম/রিটেক রেট, থানায় GD-to-FIR কনভার্সন; KPI-ডেটা তৃতীয় পক্ষের অডিট।
স্কোরকার্ড-লিংকড প্রোমোশন: শেষ ৩–৫ বছরের নির্ভুল KPI-স্কোর ছাড়া প্রোমোশন বোর্ডে উপস্থাপনই নিষিদ্ধ।
ঙ) শাস্তির নিশ্চয়তা ও সামাজিক আস্থা:
ফাস্ট-ট্র্যাক দুর্নীতি ট্রাইব্যুনাল: প্রশ্নফাঁস/বড় ঘুষ মামলার ১৮০ দিনের মধ্যে রায়, দোষী হলে সিভিল কনফিসকেশন (অস্পষ্ট সম্পদ বাজেয়াপ্ত)।
সালানা সম্পদ বিবরণী/কনফ্লিক্ট-অফ-ইন্টারেস্ট ঘোষণা—উচ্চপদে পাবলিক পোর্টালে প্রকাশ; মিথ্যা ঘোষণায় চাকরি হারানো—আইনে সুনির্দিষ্ট।
(আন্তর্জাতিক উত্তমচর্চা; CPI-স্কোর উন্নয়নে কার্যকর।)
৮) কেন এখনই?—নৈতিক ও অর্থনৈতিক জরুরি অবস্থা:
দুর্নীতির সম্মিলিত খরচ দুই অঙ্কের হাজার কোটি টাকা—শুধু নগদ ঘুষই নয়; সময়, আস্থা, আইনের শাসন ক্ষয়ে যাচ্ছে।
CPI-তে ধারাবাহিক অবনতি আন্তর্জাতিক বিনিয়োগ–ঋণ–বাণিজ্যে রিস্ক প্রিমিয়াম বাড়ায়; জনসেবায় প্রাতিষ্ঠানিক ন্যায্যতা ভেঙে পড়ে।
এক কথায়: দলবাজ প্রশাসনের বালুকাবেলায় ন্যায়, মেধা, দক্ষতা—সব ডুবে যাচ্ছে। এখনই স্কোরকার্ড-ভিত্তিক, ডেটা-চালিত, নিরপেক্ষ পদোন্নতি–নিয়োগ–সেবা সংস্কার না করলে রাষ্ট্রের বৈধতা-পুঁজি আরও ক্ষয়ে যাবে।
৯) উপসংহার: শাসনের মেরুদণ্ড—নিরপেক্ষ আমলাতন্ত্র
রাষ্ট্রীয় মেশিনের ইঞ্জিন হলো আমলাতন্ত্র। ইঞ্জিনে দলীয় বালু ঢাললে গাড়ি চলে না; ঘুষের তেল দিয়ে সাময়িক চালালেও ইঞ্জিন জ্যাম হয়।
Rule-of-Law + Meritocracy + Accountability—এই তিন চাকার গাড়ি দাঁড় করাতে হলে—
পদোন্নতির আইনি মানদণ্ডকে কাগজে নয়, স্কোরকার্ডে নামাতে হবে;
নিয়োগদ্বার থেকে প্রশ্নফাঁস–দলবাজি শূন্যে নামাতে হবে;
ঘুষ-অর্থনীতিকে ক্যাশলেস–ট্রান্সপারেন্ট সিস্টেম দিয়ে ব্যবসায়িকভাবে অলাভজনক করে ফেলতে হবে।
নইলে, “যোগ্যতা—সততা–দক্ষতা” শব্দগুলো শুধু বক্তৃতায় থাকবে—আর রাষ্ট্রযন্ত্রে চলবে দল–ঘুষ–দখলের অঘোষিত সংবিধান।
ব্যবহৃত প্রধান তথ্যসূত্র (নির্বাচিত)
CPI 2024 ও দেশের অবস্থান; TIB জাতীয় গৃহস্থালি জরিপ ২০২১/২০২৩; PSC প্রশ্নফাঁস-তদন্ত প্রতিবেদন; Promotion Rules-2002-এর বিচারিক ব্যাখ্যা; APA-সংক্রান্ত সরকারি গাইডলাইন ও বাস্তবায়ন গবেষণা ইত্যাদি। সংশ্লিষ্ট অনুচ্ছেদের শেষে সাইটেশন দেওয়া আছে।