সফলতার ৩১ বছর

এক ফোটাতেই এডিস মশার লাভা ধ্বংস

Any Akter
বাংলাবাজার ডেস্ক
প্রকাশিত: ৪:০২ অপরাহ্ন, ১২ জুন ২০২৪ | আপডেট: ৫:৩২ পূর্বাহ্ন, ২০ জুন ২০২৪
ছবিঃ সংগৃহীত
ছবিঃ সংগৃহীত

দেশে প্রতিদিনই বাড়ছে ডেঙ্গু রোগী। আক্রান্ত ও মৃত্যুতে প্রতি বছরই ছাড়াচ্ছে রেকর্ড। এমন পরিস্থিতিতে সমন্বিত উদ্যোগে মশা মারার তাগিদ বিশেষজ্ঞদের। কিন্তু এডিস মশা মারতে কীটনাশক হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে আমদানিকৃত বিটিআই। এর বাইরে প্রচলিত পদ্ধতিতে মশার প্রজননস্থল ধ্বংসে কাজ করছে সরকারের বিভিন্ন সংস্থা। কিন্তু ব্যক্তি উদ্যোগে কয়েল, অ্যারোসল ছাড়া মশা মারার আর কোনো বিশেষ কীটনাশক বাজারে পাওয়া যায় না। এই চিন্তা থেকেই সম্পূর্ণ প্রাকৃতিক উপাদানে বিষমুক্ত মশার লার্ভা মারার একটি পদ্ধতি আবিষ্কার করেছেন দেশীয় উদ্যোক্তা মো. দেলোয়ার হোসেন। তার দাবি এই সলিউশনটির মাত্র কয়েক এম এল যথেষ্ট মশার লার্ভা ধ্বংসে।

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক কীটতত্ত্ববিদ ড. কবিরুল বাশার স্যারের ল্যাবে এটির সক্ষমতা পরীক্ষা করা হয়েছে। এবার বাজারজাতকরণে সরকারের সহযোগিতা কামনা করছেন তিনি। মো. দেলোয়ার হোসেন জনকণ্ঠকে জানান, ২০১৯-২০ সালে যখন দেশে ডেঙ্গু মশার উপদ্রব বাড়তে থাকে, তখনই মশা মারার জন্য একটি কার্যকরী সলিউশন তৈরির লক্ষ্যে কাজ শুরু করি।২০২১ সালে থেকে টানা তিন বছরের নিরলস চেষ্টায় ডেঙ্গুসহ অন্যান্য মশার লার্ভা ও ডিম ধ্বংস করার বিশ্বের প্রথম বিষমুক্ত ও প্রাকৃতিক এবং শতভাগ কার্যকর সলিউশন তৈরি করতে সক্ষম হই। এই সলিউশন কীটতত্ত্ববিদ ড. কবিরুল বাশার স্যারের ল্যাবেও পরীক্ষা করা হয়েছে। পরীক্ষায় সলিউশনটি শতভাগ কার্যকর প্রমাণিত হয়েছে। ইতোমধ্যে সরকারের বিভিন্ন দপ্তরে এই সলিউশনের কার্যকারিতার বিষয়ে জানিয়েছি।যেহেতু এটি বিষমুক্ত, তাই খামারবাড়িতে পরীক্ষা করা যাচ্ছে না। প্ল্যান প্রোটেকশন ইউনিটেরও সম্মতির প্রয়োজন নেই। বাংলাদেশ স্ট্যান্ডার্ডস অ্যান্ড টেস্টিং ইনস্টিটিউশনের (বিএসটিআই) অনুমতি পেলে এটি বাজারজাতে আমরা পুরোপুরি প্রস্তুত। এখন সরকারের পক্ষ থেকে সহযোগিতা পেলে মানুষের দ্বারে দ্বারে এটি পৌঁছে দিতে পারব।বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মশার লার্ভা ও পূর্ণাঙ্গ মশা দমনে ব্যবহৃত টেমিফস (লার্ভিসাইড) ও ম্যালাথিয়ন (অ্যাডাল্টিসাইড) দুটোই অর্গানোফসফরাস ইনসেক্টিসাইড এবং এরা কন্ট্রাক ইনসেক্টিসাইড। এ দুই ইনসেক্টিসাইডই নিউরোটক্সিক। অর্থাৎ এগুলোর অবশ্যই মশা বা লার্ভার শরীরের সংস্পর্শে আসতে হবে। তাই প্রথমে নিশ্চিত করতে হবে মশার শরীরের যেসব স্থান দিয়ে এ কীটনাশকগুলো প্রবেশ করে সেসব স্থানের কোনো পরিবর্তন হয়েছে কি না।

আরও পড়ুন: ১৫ আগস্ট ঘিরে আ. লীগ-ছাত্রলীগকে সড়কে নামতে দেওয়া হবে না: ডিএমপি কমিশনার

অর্থাৎ মশার কিউটিকল, স্পাইরাকল, মুখাপাঙ্গ বা পুঞ্জাক্ষি প্রভৃতির স্বাভাবিক গঠন ও কার্যকারিতা ঠিক আছে কি না। মশা বা লার্ভা যখন কীটনাশক প্রতিরোধী হয়ে উঠবে তখন মশার এসব মরফোলোজিক্যাল পরিবর্তন হবে, যা কীটনাশকের যথাযথ প্রবেশ প্রতিরোধ করবে।

এ প্রতিরোধী হওয়ার পেছনে কীটনাশকের উৎস অর্থাৎ কোনো ধরনের উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান থেকে কেনা হয়েছে তার অ্যাকটিভ উপাদান ও ব্যবহৃত ফরমুলেন্ট কেমন এবং প্রয়োগের সময়, পরিমাণ ড্রপলেট সাইজ এবং প্রয়োগের দূরত্বের সঙ্গে স্প্রে কাভারেজ কেমন হচ্ছে, অর্থাৎ যে প্রয়োগ করছে তার চলার গতিবেগ এবং স্প্রে প্রবাহিত নজলের কোনো ফ্রিকুয়েন্ট মুভমেন্ট আছে কিনা। অর্থাৎ নজল সামান্য ঘোরাফেরা করলে এর ডায়ামিটার চেঞ্জ হয়ে যাবে যা ড্রপলেট সাইজের ওপর মারাত্মক প্রভাব ফেলবে।

আরও পড়ুন: সরকারি প্রশিক্ষণে বাড়লো ভাতা ও সম্মানী

উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, যদি ডায়ামিটার ১৫০ মাইক্রন থেকে ১৯০ মাইক্রন হয়, তবে ড্রপলেট সাইজের আয়তন দ্বিগুণ হবে। একইভাবে যদি ৩০০ মাইক্রন হয় তবে ড্রপলেট সাইজের আয়তন আটগুণ হবে। একইভাবে কমে গেলে আয়তনও একই হারে কমে যাবে যা বাতাসের বাধা অতিক্রম করে স্বাভাবিকভাবে মশা বা লার্ভার শরীরের পৌঁছতে পারবে না। ফলে কীটনাশক লিথাল ডোজে প্রয়োগ করলেও তা সাব লিথাল ডোজে পরিণত হবে এবং মশা ও লার্ভা ওষুধ প্রতিরোধী হয়ে উঠবে।

এই সলিউশনটির ক্ষেত্রে এসব প্রক্রিয়া সফলভাবে বাস্তবায়িত হয়েছে দাবি করে মো. দেলোয়ার হোসেন জানান, আমাদের সলিউশটি মাত্র এক থেকে ০.০৬২ মিলি এক লিটার পানিতে লার্ভা ধ্বংসে সফল। মশার লার্ভা যখন এটি গ্রহণ করে তখন তার শ্বাসনালী ফুলে গিয়ে একটা সময় নিস্তেজ হয়ে পরে। এই সলিউশনটির বিশেষত্ব হলো বৃষ্টির পানি যদি চলেও যায়, এর একটি অংশ মাটিতে বা পাত্রে তখনো থেকে যায়।ফলে পরবর্তীতে ওই স্থানে আবারও বৃষ্টির পানি বা অন্য কোনো পানি জমে যদি মশার লার্ভার জন্ম হয়, তখনো সলিউশনটি আপনা আপনি তার কাজ শুরু করে দেয় এবং ওই লার্ভা ও মশার নতুন ডিম ধ্বংস করে দেয়। 

এটির মূল্য কত ধরা হয়েছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, এটির এক মিলি উৎপাদন খরচ এক টাকার মতো পড়েছে। সেই হিসেবে মোড়কজাত, বাজারজাতসহ সব মিলিয়ে প্রতি মিলির খরচ দুই টাকার বেশি হবে না। ফলে সাধারণ মানুষের নাগালেই থাকবে এর ক্রয়মূল্য।

সরকারের পক্ষ থেকে বারবার বলা হচ্ছে, মশা মারার জন্য। কিন্তু এর জন্য সাধারণ মানুষের কাছে তো কোনো ওষুধ বা সলিউশন সরকার তুলে দেয়নি। আমাদের এই সলিউশনটি যদি বাজারজাত করা যায়, তা হলে সাধারণ মানুষকে আর সরকার বা সিটি করপোরেশনের দিকে তাকিয়ে থাকতে হবে না মশা মারার জন্য। নিজেরাই নিজেদের বাড়ির জমানো পানিতে এটি দিয়ে মশার লার্ভা মারতে পারবে। এটির যদি কার্যকর প্রয়োগ করা যায়, তা হলে এডিস মশা একটা সময় শূন্যে নামিয়ে আনা সম্ভব বলে আমি মনে করি। 

মো. দেলোয়ার হোসেন জানান, তার নেতৃত্বে ৭/৮ জনের একটি দল ‘এনটিডি ইনোভেশন টেক’ নামের নিজস্ব কোম্পানির ল্যাবে সহ অন্যান্য ল্যাবে এই সলিউশনটি তৈরি করেছেন। যদি সরকারের কাছ থেকে সহযোগিতা পান, তা হলে একটি নিজস্ব ল্যাব বা ফ্যাক্টরি তৈরি করে এটি বাজারজাতের কাজ শুরু করবেন। এতে এডিস মশার প্রজনন নিয়ন্ত্রণে আসবে বলেও দাবি করেন তিনি। 

প্রসঙ্গত, এডিস মশার উৎস ধ্বংস করতে বিটিআই (বাসিলাস থুরিনজেনসিস ইসরায়েলেনসিস) নামে একটি কীটনাশক আমদানি করে  ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন (ডিএনসিসি)। সিঙ্গাপুর থেকে আনা এই কীটনাশকের প্রতি কেজির দাম পড়েছে তিন হাজার ৩৮৫ টাকা।

দামি এই কীটনাশক কীভাবে ব্যবহার করতে হবে সে বিষয়ে হাতে-কলমে প্রশিক্ষণ দিতে সিঙ্গাপুর থেকে সরবরাহকারী কোম্পানির একজন কর্মকর্তাকেও আসতে হয়েছিল ঢাকায়। এই বিটিআই শুধু সিটি করপোরেশনের লোকজনই বিভিন্ন এলাকায় ছিটিয়ে দিয়ে যায়। কিন্তু দেশীয় উৎপাদিত এই লার্ভা কিলার সলিউশনটি যদি বাজারজাত শুরু হয় তা হলে ব্যক্তি নিজেরাও এটির প্রয়োগ করতে পারবে বলে জানান সংশ্লিষ্টরা।