স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও আই এস পি আর এর বিবৃতিতে বিভ্রান্তি

মাইলস্টনে বিমান বিধ্বস্তের ঘটনায় হতাহতের সংখ্যায় সন্দেহ যেসব কারণে

Any Akter
বাংলাবাজার ডেস্ক
প্রকাশিত: ১:০৪ অপরাহ্ন, ২৪ জুলাই ২০২৫ | আপডেট: ৭:০৪ পূর্বাহ্ন, ২৪ জুলাই ২০২৫
ছবিঃ সংগৃহীত
ছবিঃ সংগৃহীত

সোমবার ঢাকার উত্তরার মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজ ভবনে বিমান বিধ্বস্তের ঘটনায় এ পর্যন্ত ২৯ জনের মৃত্যু এবং শতাধিক আহতের তথ্য জানানো হয়েছে সরকারের পক্ষ থেকে। নিহতদের মধ্যে সাত জনের পরিচয় এখনো শনাক্ত করা যায়নি।

তবে সরকারের দেওয়া তথ্যের সঙ্গে আন্তঃবাহিনী জনসংযোগ পরিদপ্তর বা আইএসপিআরের তথ্যের কিছুটা পার্থক্য দেখা গেছে। মঙ্গলবার আইএসপিআর আহত ও নিহতদের যে সংখ্যা জানায়, তাতে নিহতের সংখ্যা ৩১ বলে উল্লেখ করা হয়েছে।

আরও পড়ুন: ১৫ আগস্ট ঘিরে আ. লীগ-ছাত্রলীগকে সড়কে নামতে দেওয়া হবে না: ডিএমপি কমিশনার

ওই দুর্ঘটনার পর থেকেই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে কেউ কেউ অভিযোগ করছেন, এই বিমান বিধ্বস্তের ঘটনায় নিহতদের সংখ্যা আড়াল করা হচ্ছে। এমন পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের সশস্ত্র বাহিনীর পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, মৃত্যুর সংখ্যা নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে নানা গুজব ছড়ানো হচ্ছে।

আহত, নিহত, নিখোঁজ শিক্ষার্থী ও অন্যান্যদের প্রকৃত সংখ্যা নির্ণয় করতে বুধবার স্কুলটির পক্ষ থেকে ছয় সদস্যের একটি কমিটিও গঠন করা হয়। বুধবার রাতে মাইলস্টোনের স্কুল সেকশনের প্রধান শিক্ষক খাদিজা আক্তার বিবিসি বাংলাকে জানিয়েছেন, পরিবার সূত্রে কমিটির কাছে এখন পর্যন্ত পাঁচজন নিখোঁজের তথ্য এসেছে।

আরও পড়ুন: সরকারি প্রশিক্ষণে বাড়লো ভাতা ও সম্মানী

সোমবার ঢাকার মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজ ভবনে বিমান বিধ্বস্তের ঘটনার একটি সিটিটিভি ফুটেজ বুধবার সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। এতে মাইলস্টোনের স্কুল শাখার হায়দার আলী অ্যাকাডেমিক ভবন ঘেঁষে যুদ্ধবিমানটি আছড়ে পড়ার সময় শিক্ষক- শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের ছোটাছুটি করতে দেখা যায়।

বুধবার ওই ভবনে ছিলেন ট্রেইনি শিক্ষক পূর্ণিমা দাস। নিজের ফেসবুক অ্যাকাউন্টে ওই সময়ের ঘটনার বর্ণনা দিয়ে তিনি লেখেন, ভুল তথ্য ছড়াবেন না। আপনারা যত মৃতের সংখ্যা বলছেন সেটা একেবারে সম্ভব না।

মাইলস্টোনের স্কুল ও কলেজ শিক্ষকদের কয়েকজনের সাথে কথা বলে জানা গেছে, সোমবারের ওই দুর্ঘটনায় সবচেয়ে বেশি হতাহতের ঘটনা ঘটেছে ভবনের নিচতলার তৃতীয় শ্রেণির ক্লাউড (মেঘ) ও স্কাই (মেঘ) শ্রেণিকক্ষে।

ওই দুইটি শ্রেণিকক্ষের শিক্ষার্থীদের একটি তালিকাও বিবিসি বাংলার কাছে দিয়েছে স্কুলের শিক্ষকরা। ৩৫ জন করে এই দুই ক্লাসে ৭০ জন শিক্ষার্থী ছিলেন। ওই স্কুলের একজন শিক্ষক জানান, ওই ভবনের অধিকাংশ ক্লাস শেষ হয়েছিল দুপুর একটায়। আর বিমানটি বিধ্বস্ত হয়ে পড়ে ১টা ১২ মিনিটে। এই সময়ের মধ্যে শিক্ষার্থীদের অনেকে বের হয়ে গিয়েছিল। 

আহত-নিহতের সংখ্যা নিয়ে সরকারি তথ্য

স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, মঙ্গলবার রাতে জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইন্সটিটিউটে চিকিৎসাধীন অবস্থায় আরিয়ান আশরাফ নাফি নামের নয় বছর বয়সী একটি শিশু মারা যায় ।

সর্বশেষ সরকারি বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়েছে, বর্তমানে ঢাকার জাতীয় বার্ন ইন্সটিটিউটে ভর্তি রয়েছে ৪৫ জন, ঢাকা সিএমএইচে নয় জন, কুয়েত বাংলাদেশ মৈত্রী হাসপাতালে একজন, শহীদ মনসুর আলী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে একজন ও হিউম্যান এইড রিসার্চ ল্যাব ও হাসপাতালে ভর্তি রয়েছে একজন।

বুধবার বিকেলে জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইন্সটিটিউটের পরিচালক ডা. মো. নাসির উদ্দিন এক সংবাদ সম্মেলনে জানান, জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইন্সটিটিউটে ভর্তি ৪৪ জনের মধ্যে আটজনের অবস্থা আশঙ্কাজনক। তারা সবাই আইসিইউতে চিকিৎসাধীন আছেন।

বুধবার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের পক্ষে থেকে এই দুর্ঘটনায় নিহত যে ২৯ জনের তালিকা দেওয়া হয়েছে তার মধ্যে ৭ জনের পরিচয় এখনো শনাক্ত করা যায়নি।

ডিএনএ পরীক্ষার পর সেগুলো স্বজনদের কাছে হস্তান্তরের করা হবে বলেও স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে।

শনাক্ত না হওয়া মরদেহগুলো রাখা হয়েছে মর্গে। বাকিদের মরদেহ স্বজনদের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। এই দুর্ঘটনায় যারা নিহতদের যে তালিকা প্রকাশ করা হয়েছে তার বেশিরভাগের বয়সই ৯ থেকে ১৪ বছরের মধ্যে।

স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্যে বলা হয়েছে, দুর্ঘটনা ও উদ্ধার অভিযান মিলিয়ে বর্তমানে মোট আহতের সংখ্যা ৬৯ জন। যার মধ্যে ৪১ জন শিক্ষার্থী, স্কুল স্টাফ একজন, ফায়ার ফাইটার একজন, পুলিশ একজন, সেনা সদস্য ১৪ জন, আয়া একজন, ইলেক্ট্রেশিয়ান একজন।

নিহতের সংখ্যা নিয়ে নানা আলোচনা

গত সোমবার মাইলস্টোন স্কুল ও কলেজে ওই বিমান বিধ্বস্তের ঘটনার পরই এতে মৃত্যুর সংখ্যা নিয়ে নানা আলোচনা চলছিল সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে।

মঙ্গলবার উত্তরার ওই স্কুল ক্যাম্পাসে বিবিসির সংবাদদাতাদের কাছে স্থানীয়দের কেউ কেউ দাবি করেছিলেন, এই দুর্ঘটনায় নিহতের সংখ্যা দুই শতাধিক। যদিও তারা তাদের দাবির পক্ষে কোনো তথ্য উপাত্ত দিতে পারেননি।

ঘটনার দিন রাত থেকেই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে কাউকে কাউকে প্রচারণা চালাতে দেখা যায়, সরকার প্রকৃত নিহতের সংখ্যা গোপন করছে। বুধবার সকালেও ওই স্কুলটির সামনে গিয়ে কেউ কেউ দাবি করেন, গণমাধ্যম ও সরকার এই দুর্ঘটনায় নিহতের সঠিক সংখ্যা প্রকাশ করছেন না।

বুধবার প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম তার ভেরিফায়েড ফেসবুক অ্যাকাউন্টে লিখেছেন, "স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় থেকে বিভিন্ন হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ব্যক্তিদের অবস্থা সম্পর্কে নিয়মিত আপডেট দেয়া হচ্ছে। সামরিক বাহিনীও এই প্রচেষ্টায় সহায়তা করছে। আমি দ্ব্যর্থহীনভাবে বলতে পারি, হতাহতের সংখ্যা কম করে দেখানোর কোনো কারণ সরকারের নেই"।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের একজন কর্মকর্তা বিবিসি বাংলাকে বলেছেন, তারা প্রতিটি মৃত্যুর নাম-পরিচয়সহ যাচাই-বাছাই করে তালিকা প্রকাশ করছেন। ফলে তাদের তথ্যে ভুল হওয়ার সম্ভাবনা কম বলে তারা দাবি করেছেন।

বুধবার আইএসপিআরের থেকে পাঠানো এক বিজ্ঞপ্তিতে পরিচালক সামি উদ দৌলা চৌধুরী জানান, "মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজের মৃত্যুর সংখ্যা নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ব্যাপক গুজব ছড়ানো হচ্ছে। অনেকেই না বুঝে এসব গুজবে বিশ্বাস করছেন।"

কমিটি গঠন, কী বলছে স্কুল কর্তৃপক্ষ?

বিমান দুর্ঘটনার সময়ের একটি সিসিটিভি ফুটেজে দেখা যায় মাইলস্টোনের স্কুল শাখার হায়দার আলী অ্যাকাডেমিক ভবনের সামনে যখন এটি পড়েছিল তখন দুপুর একটা ১২ মিনিট। এরপর সেখানে আগুন ধরে যাওয়া ও শিক্ষক- শিক্ষার্থী অভিভাবকদের ছোটাছুটি করতে দেখা যায়।

ওই স্কুলের শিক্ষকরা জানান, ওই ভবনে তৃতীয় থেকে অষ্টম শ্রেণির শিক্ষার্থীদের ক্লাস হতো। ওই সময় দ্বিতীয় শিফটে অনেক শ্রেণির ক্লাস শেষ হয়েছিল। কিছু শিক্ষার্থীকে তাদের অভিভাবকরা নিয়ে বের হয়ে গিয়েছিল, কিছু শিক্ষার্থী ও অভিভাবক একসঙ্গে ছিলেন। অনেকে আবার তখনও শ্রেণিকক্ষে ছিল।

মাইলস্টোনের কলেজ সেকশনের শিক্ষক রেজাউল হক বিবিসি বাংলাকে জানিয়েছিলেন, দুপুর একটাই স্কুল ছুটি হয়ে গিয়েছিল। যে কারণে অনেক শিক্ষার্থীই তখন ওই ভবন থেকে বের হয়ে গিয়েছিল।

ওই স্কুলটির ট্রেইনি শিক্ষক পূর্ণিমা দাস দুর্ঘটনার সময় ছিলেন ওই ভবনেই। বুধবার তিনি তার ফেসবুক একাউন্টে লিখেন, "আমি মাইলস্টোনের হায়দার আলী ভবনের একজন শিক্ষিকা।আপনাদের কে দুইহাত জোর করে বলছি ভুল তথ্য ছড়াবেন না। আমিও আগুনের মধ্যে আটকা পড়েছিলাম আমার চেয়ে বেশি আপনারা ফেসবুকবাসী জানবেন না তাই না?" এই বিষয়টি নিয়ে ওই শিক্ষিকার সাথে বিবিসি বাংলার পক্ষ থেকে যোগাযোগ করা হলেও কোনো সাড়া পাওয়া যায়নি।

এ বিষয়ে মাইলস্টোনের বেশ কয়েকজন শিক্ষকের সাথে কথা বলেছে বিবিসি বাংলা। তাদের অনেকেই নিজেদের নাম প্রকাশ করতে চাননি। তবে তারা জানিয়েছেন, স্কুলটির ওই ভবনটিতে দুর্ঘটনার সময় যারা ছিলেন সেই সংখ্যা ২০০ থেকে ২২০ এর বেশি ছিল না।

মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজে গত সোমবার দুপুরে বিমানবাহিনীর একটি যুদ্ধবিমান বিধ্বস্তের ঘটনায় আহত, নিহত, নিখোঁজ শিক্ষার্থী ও অন্যান্যদের প্রকৃত সংখ্যা নির্ণয় করে নাম-ঠিকানাসহ তালিকা তৈরিতে ছয় সদস্যের একটি কমিটি গঠন করে প্রতিষ্ঠান কর্তৃপক্ষ।

মাইলস্টোন স্কুল সেকশনের প্রধান শিক্ষক খাদিজা আক্তার বিবিসি বাংলাকে বলেছেন যে, বুধবার রাত সাড়ে নয়টা পর্যন্ত ৩ ছাত্রী ও ২ জন অভিভাবকের সন্ধান মিলেনি বলে তাদের পরিবার স্কুলকে অবহিত করেছে।