মুক্তিযোদ্ধা তালিকায় বড় পুনর্বিন্যাস, নতুন যুক্ত হচ্ছেন ৮৪ জন
অন্তর্বর্তী সরকারের সময়ে মুক্তিযোদ্ধার সংজ্ঞা সংশোধনের পর প্রথমবারের মতো বড় পরিসরে তালিকা পুনর্বিন্যাসের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। যাচাই–বাছাই ও শুনানি শেষে ৩৩৬ জনের মুক্তিযোদ্ধা গেজেট বাতিলের প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। একই সঙ্গে মুক্তিযুদ্ধের সহযোগী হিসেবে ২৮ জনের নাম গেজেটভুক্ত করার সুপারিশ করেছে জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিল (জামুকা)। নতুন করে ৮৪ জনকে বীর মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে তালিকাভুক্ত করার প্রস্তাবও দেওয়া হয়েছে।
মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর জমা পড়া অভিযোগ, আবেদন এবং আদালতের নির্দেশনার ভিত্তিতে এই যাচাই–বাছাই কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে। পুরো প্রক্রিয়া শেষ করতে আরও সময় লাগবে বলে জানিয়েছে মন্ত্রণালয়।
আরও পড়ুন: মহান বিজয় দিবস উপলক্ষে সেনাবাহিনীতে অনারারী কমিশন প্রদান
সরকারি সূত্র অনুযায়ী, জামুকা পুনর্গঠনের পর গত এক বছরে অনুষ্ঠিত ১১টি সভায় ২৮ জনকে ‘মুক্তিযুদ্ধের সহযোগী’ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। এঁদের নাম আগে কখনো মুক্তিযোদ্ধা তালিকায় ছিল না। কারও ক্ষেত্রে আদালতের রিট নিষ্পত্তির নির্দেশে, আবার কারও ক্ষেত্রে সরাসরি আবেদনের পর শুনানি শেষে প্রমাণ হয়েছে—নতুন সংজ্ঞা অনুযায়ী তাঁরা বীর মুক্তিযোদ্ধা নন, বরং সহযোগী শ্রেণিতে পড়েন।
অন্যদিকে, মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে স্বীকৃতি চেয়ে আবেদন করা শত শত ব্যক্তির মধ্যে ৬৪৩ জন নিজেদের দাবি প্রমাণে ব্যর্থ হওয়ায় তাঁদের আবেদন বাতিল করা হয়েছে। তবে যথাযথ প্রমাণ উপস্থাপন করায় ৮৪ জনকে নতুন করে বীর মুক্তিযোদ্ধা তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করার সুপারিশ করা হয়েছে।
আরও পড়ুন: জাতির উদ্দেশে ভাষণ দেবেন প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনূস
এ ছাড়া আগে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে গেজেটভুক্ত হয়ে নিয়মিত ভাতা পাওয়া ৩৩৬ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগের ভিত্তিতে শুনানি হয়। শুনানিতে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের সময়, স্থান ও ভূমিকা সম্পর্কে পর্যাপ্ত প্রমাণ দেখাতে না পারায় তাঁদের গেজেট বাতিলের সুপারিশ করা হয়েছে।
গত ৩ জুন জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিল আইন সংশোধনের মাধ্যমে মুক্তিযোদ্ধার সংজ্ঞা পরিবর্তন করে সরকার। সংশোধিত অধ্যাদেশ অনুযায়ী, রণাঙ্গনে দখলদার পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে সরাসরি যুদ্ধ ও সক্রিয় অংশগ্রহণকারীরাই ‘বীর মুক্তিযোদ্ধা’ হিসেবে স্বীকৃতি পাবেন। আর দেশ বা দেশের বাইরে থেকে কূটনৈতিক, সাংগঠনিক কিংবা জনমত গঠনে ভূমিকা রাখা ব্যক্তিরা বিবেচিত হবেন ‘মুক্তিযুদ্ধের সহযোগী’ হিসেবে।
তবে সংজ্ঞা পরিবর্তনের ছয় মাস পার হলেও মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের ম্যানেজমেন্ট ইনফরমেশন সিস্টেমে (এমআইএস) থাকা প্রায় ২ লাখ ৬ হাজার মুক্তিযোদ্ধার শ্রেণিবিন্যাস শুরু হয়নি। বীর মুক্তিযোদ্ধা ও মুক্তিযুদ্ধের সহযোগীদের আলাদা গেজেট প্রকাশের কাজও এগোয়নি। কর্মকর্তারা বলছেন, এতে মাঠপর্যায়ে বিভেদ ও বিশৃঙ্খলা তৈরি হতে পারে—এই আশঙ্কায় আপাতত বিষয়টি স্থগিত রাখা হয়েছে। দায়িত্ব পরবর্তী নির্বাচিত সরকারের ওপর ছেড়ে দেওয়ার ভাবনাও রয়েছে।
মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক উপদেষ্টা ফারুক-ই আজম বলেন, বর্তমানে মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা মূলত মুক্তিযোদ্ধা কোটায় সরকারি চাকরি পাওয়া ব্যক্তিদের তথ্য যাচাইয়ে ব্যস্ত। তিনি বলেন, “মুক্তিযুদ্ধ ছিল বহুমাত্রিক সংগ্রাম। ভূমিকা অনুযায়ী শ্রেণিবিন্যাস হলে ইতিহাস আরও স্পষ্ট হবে।”
মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, মুক্তিযোদ্ধা কোটায় বিভিন্ন সরকারি পদে মোট ৯০ হাজার ৫২৭ জন নিয়োগ পেয়েছেন। এর মধ্যে ৭২ হাজার ৭৭ জনের তথ্য যাচাই শেষ হয়েছে, যেখানে ভুয়া কাগজপত্র ব্যবহারের অভিযোগও পাওয়া গেছে।
মুক্তিযোদ্ধার সংজ্ঞা পরিবর্তন নিয়ে মাঠপর্যায়ে মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা গেছে। কেউ একে মর্যাদার প্রশ্ন হিসেবে দেখছেন, আবার অনেকে মনে করছেন—সুনির্দিষ্ট মানদণ্ডে শ্রেণিবিন্যাস মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসকে আরও স্বচ্ছ করবে।





