জেনে নিন ইতিকাফ কেন করা হয়, তার গুরুত্ব ও ফজিলত

চলছে পবিত্র রমজান মাস। এই পবিত্র মাসে ২০ রমজান সন্ধ্যা থেকে শুরু হবে রোজাদারদের বিশেষ আমল ইতিকাফ। ইতিকাফ শব্দের অর্থ অবস্থান করা, স্থির থাকা, কোনো স্থানে আবদ্ধ হয়ে থাকা। ইসলামের পরিভাষায় রমজান মাসের শেষ দশকে জাগতিক কাজকর্ম ও পরিবার-পরিজন থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে ইবাদতের নিয়তে মসজিদে (পুরুষ) কিংবা ঘরে (মহিলা) অবস্থান করা ও স্থির থাকাকে ইতিকাফ বলে। এর উদ্দেশ্য আল্লাহর আনুগত্য, সৃষ্টিকর্তার অনুগ্রহ লাভের আকাক্সক্ষা, সওয়াব অর্জনের প্রত্যাশা এবং লাইলাতুল কদর লাভের আশা করা। নবীজি (সা.) রমজানের শেষ দশ দিনের ইতিকাফ খুব গুরুত্বের সঙ্গে পালন করতেন। আবু হুরাইরা (রা.) বর্ণনা করেন, ‘নবী করিম (সা.) প্রতি রমজানে দশ দিন ইতিকাফ করতেন। কিন্তু ইন্তেকালের বছর তিনি ২০ দিন ইতিকাফ পালন করেন।’ (বুখারি : ১৯৩৯)। অন্য হাদিসে আয়েশা (রা.) বর্ণনা করেন, ‘নবী করিম (সা.) রমজানের শেষ দশকে ইতিকাফ করতেন। তাঁর ইন্তেকালের পর তাঁর স্ত্রীরাও ইতিকাফ করতেন।’ (মুসলিম : ১১৭২)।
রমজানের শেষ দশ দিন ইতিকাফ করা সুন্নতে মুয়াক্কাদায় কেফায়া। অর্থাৎ মসজিদের অধিবাসীদের মধ্যে কেউ একজন পালন করলে, অন্যরা সওয়াব না পেলেও গুনাহ থেকে বেঁচে যাবে। তবে সুন্নত আদায়ের সওয়াব কেবল তারাই পাবেন, যারা ইতিকাফে বসবেন। সুন্নত ইতিকাফের সময় শুরু রমজানের ২০ তারিখ সূর্য অস্ত যাওয়ার কিছুক্ষণ পূর্ব থেকে। আর ঈদুল ফিতরের চাঁদ উঠলে সময় শেষ হয়।
আরও পড়ুন: নুসুক অ্যাপ এখন থেকে ইন্টারনেট ছাড়াই ব্যবহার করা যাবে
ইতিকাফকারী পুরুষ ২০ রমজান আসরের নামাজের পর সূর্যাস্তের আগে মসজিদে পৌঁছবেন এবং কোণে একটি ঘরের মতো পর্দা দিয়ে ঘেরাও করে অবস্থান নেবেন; এমনভাবে যেন প্রয়োজনে জামাতের সময় পর্দা খুলে মুসল্লিদের জন্য নামাজের ব্যবস্থা করা যায়। এ স্থানে পানাহার ও শয়ন করবেন এবং বিনা প্রয়োজনে এখান থেকে বের হবেন না। তবে প্রাকৃতিক প্রয়োজনে বা ফরজ গোসল প্রভৃতি কাজে অথবা শরিয়তের প্রয়োজনে যেমন জুমার নামাজ প্রভৃতির জন্য বের হওয়া জায়েজ। আর নারীরা ঘরের নির্দিষ্ট স্থানে, যেখানে তিনি নামাজ আদায় করেন, সেখানেই ইতিকাফ করবেন। বাড়ির নির্দিষ্ট স্থান না থাকলে যেকোনো পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন স্থানে ইতিকাফ করবেন এবং ঈদের চাঁদ উদয় না হওয়া পর্যন্ত ইতিকাফের স্থান ত্যাগ করবেন না।
ইতিকাফের অন্যতম উদ্দেশ্য লাইলাতুল কদর অন্বেষণ করা। কারণ নবীজি (সা.) রমজানের শেষ দশকে কদর রাত খোঁজার জন্য নির্দেশ দিয়েছেন। কোনো কোনো হাদিসে শেষ দশকের বেজোড় রাতের কথা বলা হয়েছে। যাবতীয় নফল ইবাদত থেকে এটি ব্যতিক্রম। কারণ নবীজি (সা.) দুটি নফল ইবাদত কাজা করেছেন। একটি তাহাজ্জুদের নামাজ, আরেকটি রমজানের শেষ দশকের ইতিকাফ। যে রাতে তিনি তাহাজ্জুদ পড়তে সক্ষম হতেন না, পরবর্তী দিবসে তিনি তা কাজা করে নিতেন। সাধারণত পড়তেন ৮ রাকাত; কাজা করার সময় পড়তেন ১২ রাকাত। দ্বিতীয়ত, ইতিকাফ। রোজা ফরজ হওয়ার পর কোনো রমজানেই নবীজি (সা.) ইতিকাফ ছেড়ে দেননি। ইন্তেকালের আগের বছর ওজরবশত ইতিকাফ করতে পারেননি; ইন্তেকালের বছর রমজানে তিনি কাজাসহ মোট ২০ দিন ইতিকাফ করেন। এ কারণেই যুগে যুগে বুজুর্গ ব্যক্তিরা তাহাজ্জুদ এবং ইতিকাফ, এই দুই নফল আমল পারতপক্ষে পরিত্যাগ করেন না।
আরও পড়ুন: ঐতিহাসিক হোসেনি দালান থেকে তাজিয়া মিছিল শুরু
ইতিকাফকারীর জন্য রয়েছে প্রভূত কল্যাণ ও পুরস্কার। যে ব্যক্তি একনিষ্ঠ মনে সওয়াবের নিয়তে ইতিকাফ করে, তার সব সগিরা গুনাহ মাফ করে দেওয়া হয়। নবী করিম (সা.) বলেন, ‘ইতিকাফকারী ব্যক্তি যাবতীয় পাপ থেকে মুক্ত থাকে আর ইতিকাফে লিপ্ত থাকার জন্য কোনো ব্যক্তি বাইরের কোনো নেক কাজ করার সুযোগ থেকে বঞ্চিত থাকলেও ওই নেক কাজগুলোর পূর্ণ নেকি সে লাভ করবে।’ (ইবনে মাজা)। আরও বলেন, ‘ইতিকাফকারী মূলত গুনাহ থেকে দূরে থাকে এবং তাকে ইতিকাফের বিনিময়ে এত বেশি নেকি দেওয়া হবে, যেন সে সব নেকি অর্জনকারী।’ (ইবনে মাজা)। আরও বলেন, ‘যে ব্যক্তি রমজানের শেষ দশক ইতিকাফ করবে, তার জন্য দুই হজ ও দুই ওমরার সওয়াব রয়েছে।’ (বায়হাকি)
ইতিকাফে যিনি বসবেন তাকে কিছু বিষয় অবশ্যই খেয়াল রাখতে হবে- ১. ইতিকাফকালে স্ত্রী সহবাস বা স্ত্রী সহবাসে উত্তেজনা সৃষ্টিকারী কিছু করলে ইতিকাফ বাতিল হয়ে যাবে। ২. মানবীয় জরুরত যেমন- পায়খানা-প্রস্রাব অথবা শরয়ি জরুরত যেমনÑ জুমার নামাজে শরিক হওয়া ছাড়া মসজিদ থেকে বের হলে ইতিকাফ বাতিল হয়ে যাবে। ৩. এসব অনুমোদিত জরুরতে বের হয়েও প্রয়োজনের বেশি অবস্থান করলে ইতিকাফ থাকবে না। ৪. কেউ ইতিকাফ শুরু করে কোনো কারণে ছেড়ে দিলে পরে তা কাজা করতে হবে এবং রোজার সঙ্গেই কাজা করতে হবে। ৫. খাদ্য বা অজুর পানি এনে দেওয়ার মতো কোনো লোক না থাকলে তার জন্য মসজিদের বাইরে যাওয়া জায়েজ; তবে খুব তাড়াতাড়ি ফিরে আসতে হবে। (কুদুরি, ফাতাওয়া শামি, হাশিয়ায়ে তাহতাবি)
ইতিকাফ মানুষকে দুনিয়ার ঝামেলা ত্যাগ করে নিবিষ্ট মনে ইবাদতের শিক্ষা দেয় এবং অল্প সময়ের জন্য হলেও আল্লাহর সঙ্গে তার সম্পর্ক জুড়ে দেয়। এতে মানুষের পক্ষে অন্তিমকালে দুনিয়া ত্যাগ করা সহজ হয় এবং দুনিয়ার মহাব্বতের পরিবর্তে আল্লাহর মহাব্বত বৃদ্ধি পায়। ইতিকাফকারীর উদাহরণ সেই হাজতি ব্যক্তির মতো, যে কোনো মহান ব্যক্তির দরবারে হাত পেতে থাকে এবং বলে, যে পর্যন্ত না আমার হাজত পূর্ণ করা হয়, আমি এই দরবার ত্যাগ করব না।