পিরোজপুরে শত বছরের ভাসমান নৌকার হাট জমে উঠলেও ক্রেতা বিক্রেতাদের ভোগান্তি

পিরোজপুরে জমে উঠেছে শত বছরের ঐতিহ্যবাহী ভাসমান নৌকার হাট। ভাসমান নৌকার হাট জমে উঠলেও ক্রেতা এবং বিক্রেতাদের ভোগান্তির যেন শেষ নেই। বৃষ্টি হলে দাঁড়ানোর কোন জায়গা নেই, বৃষ্টিতে ভিজে কিংবা রোদের তীব্র তাপে পুড়ে ক্রয় বিক্রয় করতে হয় নৌকা ব্যবসায়ী আর ক্রেতাদের।
বছরের তিন মাস কয়েক কিলোমিটার এলাকা জুড়ে বিস্তৃত এই হাটটি জমজমাট হয়ে ওঠে। বর্ষা মৌসুমে যেন একটু বেশি জমজমাট হতে দেখা যায়। এই হাটে বিক্রেতারা যেমন খুশি নৌকা বিক্রি করে তেমনি খুশি ক্রেতারা নৌকা কিনে। ক্রেতা বিক্রেতার মধ্যে কেনাবেচার এক ধুম লেগে যায় সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত।
আরও পড়ুন: খালেদা জিয়ার ৮০তম জন্মবার্ষিকী উপলক্ষ্যে নেত্রকোণায় যুবদলের মিলাদ মাহফিল
বর্ষা মৌসুম এলে চোখ জুড়ানো নৌকার ভাসমান হাটের দেখা মিলবে পিরোজপুর জেলার নেছারাবাদ উপজেলার আটঘর কুড়িয়ানায়। শতশত নৌকা পসশা সাজিয়ে বসে আছে বিক্রেতারা। বছরে একবার ব্যবহার উপযোগী এই নৌকা কিনতে ভিড় জমাচ্ছেন বরিশাল বিভাগের বিভিন্ন জায়গার মানুষজন। ঘাস কাটা, মাছ ধরা ,পেয়ারা, আমড়া পাড়ার প্রয়োজনীয় কাজে ব্যবহার উপযোগী এই নৌকা কিনতে আসছেন বরিশাল, বাকেরগঞ্জ, ঝালকাঠি, নলছিটি, বানরীপাড়া নাজিরপুর গোপালগঞ্জ বৈরাকাটা কাঠালিয়া, রাজাপুর সহ বিভিন্ন অঞ্চলের মানুষ। বছরের আষাঢ় শ্রাবণ ভাদ্র এই তিন মাস জমে ওঠে ভাসমান এই নৌকার হাট। সপ্তাহের সোমবার ও শুক্রবার ভাসমান এই নৌকার হাটের দেখা মিলে, তবে সপ্তাহের শুক্রবারে পুরোপুরি জমে ওঠে আটঘর কুড়িয়ানার এই ভাসমান নৌকার হাট। দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে পর্যটকের ভিড় লক্ষ্য করার পাশাপাশি বিদেশি পর্যটকেরও আগমন ঘটে এই ভাসমান নৌকার হাটে।
নেছারাবাদ উপজেলার আটঘর কুরিয়ানায় ভাসমান নৌকার হাটে সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, সকালে সূর্য উদয়ের সাথে সাথে শাপলা ফুলের মত ফুটে আছে সারি সারি নৌকা। আটঘর খাল থেকে ট্রলার কিংবা ইঞ্জিল চালিত কোন নৌকা ভাসমান হাটের গা ঘেঁষে যাওয়ার পরে সূর্যমুখী ফুলের মত দুলতে থাকে নৌকাগুলি। এ দৃশ্য দেখলে যে কারো চোখের দৃষ্টি এক মুহূর্তের জন্য এদিক-ওদিক করার মত নয়। এমন দৃশ্য দেখতে প্রতি হাটে ভিড় করে ভ্রমন্ত পিপাসু মানুষ। এত সৌন্দর্যের ভিরেও ভোগান্তির শেষ নেই। কখনো বৃষ্টিতে ভিজে আবার কখনো রোদে পুড়ে বেচাকেনা হয় নৌকা।
আরও পড়ুন: জৈন্তাপুরে জাফলং থেকে লুট হওয়া ৭ হাজার ঘনফুট পাথর উদ্ধার
প্রশাসনের উদ্যোগে যদি ক্রেতা বিক্রেতাদের জন্য এবং পর্যটকদের বসার জায়গা তৈরি করে দেয়া যায়, তাহলে ভাসমান এই হাটের সৌন্দর্য আরো কয়েক গুণ বৃদ্ধি পাবে বলে মনে করেন ব্যবসায়ী এবং ক্রেতারা।
শত বছরের পুরনো ভাসমান নৌকার হাট দেখতে আসেন শফিক আহমেদ তিনি বলেন, ঐতিহ্যবাহী স্বরূপকাঠির ভাসমান নৌকার হাট। প্রতিবছর এই সময়টাতে ঘুরতে আসি। দূর দূরান্ত থেকে অনেক দর্শণার্থী ভিড় করে এই নৌকার হাটে। এই নৌকার হাতটি ঐতিহ্যবাহী প্রায় ১০০ বছর আগে থেকে এই নৌকার হাটটি চলে আসছে। বিশেষ করে নৌকার হাট দেখার জন্য মানুষ বেশি আছে। যারা নৌকা কিনতে আসে তারা কেউ পেয়ারা ব্যবসায়ী আমরা ব্যবসায়ী। কিছু মানুষ আছে নৌকা দিয়ে গৃহের কাজকর্ম পরিচালনা করে থাকে। আবার কেউ মাছ ধরে। এরাই মূলত নৌকাটা বেশি কিনে থাকেন। এক বছরের জন্য এই নৌকা কিনে ক্রেতারা।
বিক্রেতা হুমায়ুন কবির বলেন, পিরোজপুর জেলার নেছারাবাদ উপজেলার আটঘর কুরিয়ানার ভাসমান নৌকারহাট এটা ১০০ বছরের আগের হাট। এই হাট বসে প্রতি শুক্রবার ও সোমবার। প্রতিহাটে ২০০ থেকে ৩০০ নৌকা বিক্রি হয়। বরিশাল, ঝালকাঠি রাজাপুর, উজিরপুর সহ বিভিন্ন জায়গা থেকে নৌকা কিনতে আসে ক্রেতারা। দূর দূরান্ত থেকে যে মানুষজন আসে তারা বৃষ্টিতে ভেজে কিংবা রোদের তীব্র তাপে পুড়ে, এখানে বসার কোন জায়গা নেই। প্রশাসনের পক্ষ থেকে যদি বসার কোন টল ঘর দেয়া হতো তাহলে আমাদের বিক্রেতাদের বৃষ্টিতে ভিজতে হতো না ও ক্রেতারাও নিশ্চিন্তে নৌকা কিনতে পারতো। এছাড়াও বিভিন্ন জায়গা থেকে যে পর্যটকরা ঘুরতে আসে তারাও এই সমস্যায় পরে। এখানে একটি টল ঘর দরকার যেখানে মানুষ বৃষ্টিতে কিংবা রোদে বসতে পারবে।
নারায়ণপুর থেকে নৌকা কিনতে আসা ওয়াহেজ উদ্দিন হাওলাদার বলেন, আমি নারায়নপুর থেকে নৌকা কিনতে এসেছি। এই নৌকা আমাদের সংসারের ব্যবহারের কাজে ব্যবহার করা হবে। নৌকা কিনেছি তিন হাজার দুইশত টাকায়, খাজনা দিয়েছি ৩২০ টাকা।
নৌকা বিক্রেতা আব্দুল কাইয়ুম বলেন, আমি ২৫ টি নৌকা নিয়ে এসেছি বিক্রির জন্য এই হাটে। কেনাবেচা আজকে কম হয়েছে। এখন পর্যন্ত নয়টা নৌকা বিক্রি করতে পেরেছি। তুলনামূলকভাবে এখন নৌকার দাম কম। ২৫০০ টাকা থেকে শুরু করে ৫০০০ টাকা পর্যন্ত নৌকা বিক্রি হয়। এই নৌকা নিয়ে মানুষ পেয়ারা পারে, মাছ ধরে, ঘাটে নৌকা বায় ইত্যাদি সহ অনেক কাজে ব্যবহার করে।
বাকেরগঞ্জ থেকে নৌকা কিনতে আসা আশরাফ আলী বলেন, আমি নৌকা কিনতে এসেছি, এই নৌকা কিনে গরুর জন্য ঘাস কাটবো হাটে যাব বাজারে যাব বিভিন্ন কাজে ব্যবহার করব।
নৌকা বিক্রেতা রুস্তম আলী বলেন, এই নৌকারহাট শত বছরের পুরনো এখানে অনেক বছর ধরে নৌকা বিক্রি করতে আসি। এই নৌকাগুলো তৈরি করা হয় নেছারাবাদ উপজেলার ডুবি এবং চামী গ্রামে। প্রতিটা নৌকা পাইকারি ধরে কিনে আনি ২ হাজার থেকে শুরু করে বিভিন্ন দামে। কার্ড ভেদে নৌকার দাম নির্ধারণ হয়। নৌকা প্রতি ৫০০ টাকা থেকে শুরু করে ১০০০ টাকা লাভ করি। কেনার উপরে নির্ভর করে কত টাকা লাভ হবে।
নৌকা ব্যবসায়ী আরো বলেন, আমাদের এই আটঘর নৌকার হাটে বসার কোন জায়গা নেই। নৌকা গুলি রাস্তায় উঠিয়ে বেচাকেনা করতে হয়। অনেক সমস্যায় পড়তে হয়। বৃষ্টিতে ভিজতে হয় মাঝে মাঝে। এখানে একটি ঘরের দরকার আছে, যেখানে ক্রেতা ও বিক্রেতা সহ যারা ঘুরতে আসে তারাও বসতে পারবে।
ভাসমান নৌকার হাটের ইজারাদার আবুল বাশার বলেন, ভাসমান নৌকারহাট শত বছরের পুরনো পরিচিত এবং ঐতিহ্যবাহী। এই আটগর হাটে নৌকা গুলি কিনে বিশেষ করে মানুষ পেয়ারা, আমড়া,মাছ ধরা গরুর ঘাস কাটা সহ বিভিন্ন কাজে ব্যবহার করে। প্রতিহাটে ২০০ থেকে আড়াইশো নৌকা বিক্রি হয়। এখানে বসার কোন জায়গা নেই আমাদের খাজনা আদায় করতে হয় বৃষ্টিতে ভিজে। এই মৌসুমে সবথেকে বেশি বৃষ্টি পড়ে। তাই উপজেলা প্রশাসনের কাছে বিনীত অনুরোধ করবো যাতে আমাদের একটি ঘরের ব্যবস্থা করে দেয়। যেখানে ক্রেতা বিক্রেতা সবাই বসতে পারবে। প্রতি মৌসুমে ১৫ থেকে ১৬ কোটি টাকার নৌকা বিক্রি হয় এই ঐতিহ্যবাহী ভাসমান নৌকার হাটে।
নেছারাবাদ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা বলেন, নেছারাবাদ উপজেলায় শত বছরের পুরনো একটি ভাসমান নৌকার হাট রয়েছে। উপজেলার বিভিন্ন জায়গায় ছোট নৌকা তৈরি করে এই হাটে নিয়ে আসে বিক্রির জন্য। সপ্তাহে শুক্রবার ও সোমবার এই ভাসমান নৌকার হাট বসে। বিভিন্ন জায়গা থেকে লোকজন দেখার জন্য আসে শত বছরের পুরনো এই নৌকার হাট দেখতে। এখানে বিদেশ থেকে পর্যটক ঘুরতে আসে। আমরা চাই এটি আরো সমৃদ্ধ হোক, যারা এখানে আসে তাদের সুযোগ সুবিধার কথা আমরা ভাবছি। কিভাবে তাদের আরো ভালো ব্যবস্থা করা যায় অন্যান্য বিষয় কিভাবে আরো বেশি উন্নত করা যায় সেসব চিন্তা আমাদের রয়েছে।
দেশের ভ্রমণ পিপাসুদের পাশাপাশি ভিড় করে বিদেশি পর্যটকেরাও। প্রশাসনের পক্ষ থেকে সঠিকভাবে উদ্যোগ নিলে নেছারাবাদ উপজেলার ভাসমান নৌকার হাটটি পর্যটক কেন্দ্রে গড়ে উঠতে পারে। সৃষ্টি হতে পারে আটঘর করিয়ানা এলাকার বেকার যুবকদের কর্মসংস্থান।