বাংলাদেশের মুদ্রাস্ফীতি : মূল্যবৃদ্ধি থেকে দীর্ঘমেয়াদি পরিণতি

১. মূল্যস্ফীতির ক্রমান্বয় উত্থানঃ-
গত দুই বছরে বাংলাদেশ ইতিহাসের অন্যতম দীর্ঘস্থায়ী ও যন্ত্রণাদায়ক মুদ্রাস্ফীতির মুখোমুখি হয়েছে।
আরও পড়ুন: গণ আকাঙ্ক্ষা বাস্তবায়নে হতাশার মুখোমুখি
• ২০২৩ সালের শেষ থেকে ২০২৪ সালের শুরু: মুদ্রাস্ফীতি ১০% ছাড়িয়ে যায়।
• নভেম্বর ২০২৪: মুদ্রাস্ফীতি চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছে ১১.৩৮% হয়, যার মূল কারণ ছিল খাদ্যপণ্যের দাম বৃদ্ধি।
আরও পড়ুন: জম্মু-কাশ্মীর: আলাদা পরিচয় থেকে জাতীয় মূলধারায়
• ডিসেম্বর ২০২৪: সামান্য হ্রাস পেয়ে ১০.৮৯% হলেও খাদ্য মুদ্রাস্ফীতি ছিল ১২.৯২%।
• জানুয়ারি থেকে মে ২০২৫: সার্বিক মুদ্রাস্ফীতি ৯%-এর ওপরে রয়ে যায়, ধীর গতিতে কমতে থাকে।
• জুন ২০২৫: অবশেষে মুদ্রাস্ফীতি কমে হয় ৮.৪৮%, যা দুই বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন, কিন্তু সরকারের নির্ধারিত ৬.৫% লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে অনেক বেশি।
মাস সার্বিক মুদ্রাস্ফীতি খাদ্যপণ্যের মূল্যস্ফীতি অখাদ্যপণ্যের মূল্যস্ফীতি
জানুয়ারি ২০২৫ ৯.৯৪% ১০.৭২% ৯.৩২%
মার্চ ২০২৫ ৯.৩৫% ৮.৯৩% ৯.৭০%
মে ২০২৫ ৯.০৫% ৮.৫৯% ৯.৪২%
জুন ২০২৫ ৮.৪৮% ৭.৩৯% ৯.৩৭%
২. মুদ্রাস্ফীতির কারণসমূহঃ-
ক) খাদ্য সরবরাহে বিপর্যয়:-
বন্যা, ফসলের ঘাটতি এবং পরিবহন ব্যবস্থার দুর্বলতার কারণে চাল ও ভোজ্যতেলের দাম ব্যাপক হারে বৃদ্ধি পায়।
খ) মুদ্রার অবমূল্যায়ন:-
বাংলাদেশি টাকার মান প্রায় ১৬% কমে যাওয়ায় আমদানি ব্যয় বেড়ে যায়, বিশেষ করে জ্বালানি ও খাদ্যপণ্যে।
গ) ঢিলেঢালা আর্থিক নীতি:-
বাংলাদেশ ব্যাংক সুদের হার বাড়াতে বিলম্ব করে এবং সরকারের অতিরিক্ত ঋণ গ্রহণ অর্থের সরবরাহ বাড়িয়ে দেয়, যার ফলে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ হয়।
ঘ) রাজনৈতিক অস্থিরতা:-
২০২৪ সালে ধর্মঘট, হরতাল ও কারফিউয়ের কারণে বাণিজ্য ও উৎপাদন মারাত্মকভাবে ব্যাহত হয়।
৩. কারা বেশি ক্ষতিগ্রস্ত?
• দারিদ্র্য বেড়েছে: ইতোমধ্যে ৭.৯ মিলিয়ন মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে নেমে গেছে।
• বাস্তব আয় কমেছে: টানা তিন বছর ধরে মজুরি মুদ্রাস্ফীতির তুলনায় পিছিয়ে রয়েছে।
• গার্মেন্টস শ্রমিকদের বিক্ষোভ: মজুরি না বাড়ায় জীবনযাত্রার ব্যয় মেটাতে না পেরে আন্দোলন করছে তারা।
• গ্রামাঞ্চলে সংকট: গ্রামীণ এলাকায় অখাদ্যপণ্যের মূল্যস্ফীতি প্রায় ১০% ছুঁয়েছে, যা কৃষক ও নিম্নআয়ের মানুষদের জন্য বড় আঘাত।
৪. দীর্ঘমেয়াদি ঝুঁকি কী?
• অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির ধীর গতি: বিশ্বব্যাংক পূর্বাভাস দিয়েছে, জিডিপি প্রবৃদ্ধি কমে হবে মাত্র ৩.৩%, যা গত ৩৬ বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন।
• অতিরিক্ত দারিদ্র্য: আরও ৩০ লাখ মানুষ চরম দারিদ্র্যে নিমজ্জিত হতে পারে।
• ব্যাংকিং খাতের দুর্বলতা: সঞ্চয় কমে যাওয়ায় ব্যাংকিং ব্যবস্থায় চাপ তৈরি হচ্ছে।
• বিনিয়োগে স্থবিরতা: উচ্চ মূল্যস্ফীতি ও রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা বিনিয়োগ নিরুৎসাহিত করছে।
• গঠনগত ক্ষতি: বৈষম্য, নীতির প্রতি অবিশ্বাস এবং প্রতিষ্ঠানগত দুর্বলতা দীর্ঘস্থায়ী হতে পারে।
৫. এখন কী করতে হবে?
ক) সুদের হার বাড়ানো:-
মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে নীতিনির্ধারকদের আরও কঠোরভাবে সুদের হার ও অর্থ সরবরাহ নিয়ন্ত্রণ করতে হবে।
খ) মুদ্রার স্থিতিশীলতা বজায় রাখা:-
বাজারভিত্তিক বিনিময় হার অব্যাহত রাখতে হবে, তবে তা যেন হঠাৎ করেও পতন না ঘটায়।
গ) দরিদ্র জনগণের সহায়তা:-
নগদ ভাতা, খাদ্য সহায়তা, ভিজিএফ কর্মসূচির মতো উদ্যোগ বাড়াতে হবে।
ঘ) খাদ্য সরবরাহ শৃঙ্খলা মজবুত করা:-
সংরক্ষণ, পরিবহন ও পাইকারি বাজারের আধুনিকায়নে বিনিয়োগ করতে হবে।
ঙ) বিনিয়োগকারীদের আস্থা ফিরিয়ে আনা:-
রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করে ব্যাংক ও রাজস্ব ব্যবস্থার সংস্কার প্রয়োজ
৬. উপসংহারঃ-
বাংলাদেশ এখন একটি সংকটপূর্ণ সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে। মুদ্রাস্ফীতি হয়তো কিছুটা কমেছে, কিন্তু এর অভিঘাত দীর্ঘস্থায়ী হতে পারে। যদি এখনই সমন্বিত জাতীয় কৌশল গ্রহণ না করা হয়, তবে দেশের অর্থনীতি এক দীর্ঘ মন্দার দিকে ধাবিত হতে পারে।
মুদ্রাস্ফীতির বিরুদ্ধে লড়াই শুধু সংখ্যার হিসাব নয়—এটা আমাদের ১৮ কোটি মানুষের স্বপ্ন ও জীবনমান রক্ষার লড়াই।
লেখক পরিচিতি: এম এ মতিন একজন রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও অর্থনৈতিক পর্যবেক্ষক