শত কোটি টাকার মিশনে সাবেক ছাত্রলীগ নেতা, গণপূর্তের সকল বাণিজ্য তার নিয়ন্ত্রণে
বিগত ২০০৩ সালে সহকারী প্রকৌশলী হিসেবে গণপূর্ত অধিদপ্তরে যোগদানের পর থেকে অদ্যাবধি বদরুল আলম খানের বিরুদ্ধে দুর্ণীতির মাধ্যমে নামে বেনামে বিপুল পরিমাণ অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগ উঠেছে। বর্তমানে তিনি গণপূর্তের সাভার সার্কেলের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী হিসেবে কর্মরত রয়েছেন। এ ঘটনায় বিষয়টি তদন্ত করে ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য দুর্নীতি দমন কমিশনে (দুদক) অভিযোগ দেয়া হয়েছে। বুধবার (১০ ডিসেম্বর) দুপুরে দুর্নীতি দমন কমিশনে এই অভিযোগটি দেয়া হয়।
আরও পড়ুন: গুজব ছড়াবেন না, চিকিৎসা নিতে পারছেন খালেদা জিয়া: ডা. জাহিদ হোসেন
অভিযোগে জানা যায়,বদরুল আলম, দুদক চেয়ারম্যান এর নিকট আত্মীয় পরিচয়ে দিয়ে গণপূর্ত অধিদপ্তরে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছে। এদিকে গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের সচিব এর নামে তোলে নিয়মিত মাশোহারা।
অভিযোগে জানা যায়, বদরুল আলম খানের গ্রামের বাড়ি ব্রাহ্মণবাড়িয়া। সেই সুবাদে পতিত স্বৈরাচার শেখ হাসিনার ঘনিষ্ঠ সহচর গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের সাবেক মন্ত্রী ওবায়দুল মুক্তাদিরের ব্যক্তিগত রাজনৈতিক সহকারী মুসা আনসারীর সাথে ঘনিষ্ঠতা গড়ে তোলে। মুসা আনসারী ২০১২ সালে তাকে ছাত্রলীগের সাবেক নেতা হিসেবে পরিচয় করিয়ে দেন ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সাবেক সংসদ সদস্য ওবায়দুল মুক্তাদিরের সাথে। যার সুবাদে দামী উপঢৌকন দিয়ে বদরুল আলম খান সাবেক মন্ত্রী ওবায়দুল মুক্তাদিরের ঘনিষ্ঠজন হিসেবে ক্ষমতাধর হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন। ছাত্রলীগের ট্যাগ লাগিয়ে তিনি ২০১৪ সালে তোফায়েল আহমেদের কাছে তদবির করেন ভোলায় লোভনীয় পোস্টিংয়ের জন্য। ভোলায় ২০১৪ সাল থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত দীর্ঘ ৫ বছরের চাকুরি জীবনে তিনি তোফায়েল আহমেদের ভাতিজা মইনুল হোসেন বিপ্লব এমপি এবং আলী আজম মুকুল এমপি এবং নুরুন্নবী শাওন এমপির সাথে জোটবদ্ধ হয়ে সিন্ডিকেট তৈরি করে চিফ জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালত ভবন নির্মাণ, ২৫০ শয্যাবিশিষ্ট হাসপাতাল নির্মাণ প্রকল্প , পুলিশ বিভাগের নতুন থানা নির্মাণ, জেলা ও উপজেলা টিটিসি নির্মাণ, উপজেলা ও ইউনিয়ন ভূমি অফিস নির্মাণ, সাব-রেজিস্ট্রি অফিস নির্মাণ ইত্যাদি প্রকল্পের সকল দরপত্র নিজেদের নিয়ন্ত্রনে নেন এবং পছন্দের ঠিকাদারকে কাজ পাইয়ে দিয়ে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নেন। এছাড়াও তিনি ভোলা গণপূর্ত বিভাগে চলমান মেরামত কাজ থেকে ১৫% হারে টাকা হাতিয়ে নিয়ে বিপুল পরিমাণ অবৈধ সম্পদের মালিক হন।
আরও পড়ুন: নিবন্ধন প্রক্রিয়ায় গড়িমসি করছে নির্বাচন কমিশন, রাষ্ট্র সংস্কার আন্দোলনের অভিযোগ
তিনি ওবায়দুল মুক্তাদির চৌধুরীর মাধ্যমে বিপুল অংকের অর্থের বিনিময়ে ২০২০ সালে গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী শরীফ আহমেদের কাছে তদবির করে ময়মনসিংহে পোস্টিং নেন। এসময় ব্যাপক অনিয়ম ও দুর্ণীতি করার কারনে তাকে মন্ত্রণালয় থেকে প্রধান প্রকৌশলীকে নির্দেশনার মাধ্যমে ময়মনসিংহ থেকে ওএসডি করা হয়। ময়মনসিংহ গণপূর্ত বিভাগে চাকুরিকালে তিনি বিধি বহির্ভূত ভাবে নিয়মনীতি এর তোয়াক্কা না করে লাখ লাখ টাকা ঘুষের বিনিময়ে ময়মনসিংহ শহরে অসংখ্য বহুতল ভবনের নক্সা অনুমোদন করেন। তিনি তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী হিসেবে চট্টগ্রাম গণপূর্ত সার্কেল-১-এ কর্মরত থাকাকালীন সময়ে সরকারী কর্মকর্তা-কর্মচারিদের জন্য বহুতল আবাসিক ভবন নির্মাণ প্রকল্পে ব্যাপক অনিয়ম ও দুর্নীতির মাধ্যমে কোটি কোটি টাকা লুটপাট করেন। ২০২৪ সালে ওবায়দুল মুক্তাদির চৌধুরী গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রী হলে বদরুল মন্ত্রীর রাজনৈতিক এপিএস মুসা আনসারীকে কোটি টাকা ঘুষ দিয়ে ঢাকা গণপূর্ত সার্কেল-২ অথবা ঢাকা গণপূর্ত সার্কেল-৩-এর যে কোন একটিতে পদায়নের জন্য গণপূর্ত অধিদপ্তরের প্রধান প্রকৌশলীর উপর চাপ সৃষ্টি করেন। ওবায়দুল মুক্তাদির চৌধুরীর অব্যাহত চাপের মুখে বদরুলকে ঢাকার গুরুত্বপূর্ণ কোন সার
আরও জানা যায়, ২০২৪ সালের ৫ই আগস্ট ছাত্র-জনতার বিপ্লবের পর বদরুল ইতিপূর্বে ওবায়দুল মুক্তাদিরের চাপ সত্ত্বেও পোস্টিং না পাওয়ায় ক্ষুব্ধ হয়ে গণপূর্ত অধিদপ্তরের প্রধান প্রকৌশলীর দরজায় লাথি মারাসহ উদ্ধত আচরণ করেন এবং পূর্ব প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী পোস্টিং দাবী করেন। তার চাপে পড়ে প্রধান প্রকৌশলী অসহায় হয়ে গণপূর্ত অধিদপ্তরের সবচেয়ে গুরুত্ত্বপূর্ণ সাভার সার্কেলে তাকে পদায়ন করেন। সাভার গণপূর্ত সার্কেল ৪ টি গুরুত্বপূর্ণ বিভাগের সমন্বয়ে গঠিত, বিভাগগুলো হলো, মিরপুর বিভাগ, সাভার বিভাগ, গাজীপুর বিভাগ ও মানিকগঞ্জ বিভাগ। এই চারটি গণপূর্ত বিভাগে সরকারের আবাসন প্রকল্প ও অন্যান্য গুরুত্ত্বপূর্ণ নির্মাণ কাজ চলমান। ওই কাজসমূহে স্বচ্ছতা ও নিরপেক্ষতা বজায় রাখার স্বার্থে শতকরা ৮০ ভাগ কাজ এলটিএম পদ্ধতিতে ও শতকরা ২০ ভাগ কাজ ওটিএম পদ্ধতিতে দরপত্র আহ্বান করতে গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা থাকা সত্ত্বেও তিনি নিজের সার্কেলের আওতায় শতকরা ৮০ ভাগ নির্মাণ কাজ ১৫% টাকার বিনিময়ে ওটিএম পদ্ধতিতে দরপত্র আহ্বানের মাধ্যমে বিক্রি করেছেন।
দুর্নীতির মাধ্যমে করা অবৈধ সম্পদের মধ্যে রয়েছে, তার স্ত্রীর নামে ঢাকার মালিবাগে গার্মেন্টস ফ্যাক্টরির ব্যবসা, রিয়েল এস্টেট এর ব্যবসা, বিভিন্ন নামে-বেনামে বিভিন্ন লাইসেন্সের মাধ্যমে ঠিকাদারী ব্যবসা, স্ত্রী ও বেনামে ব্যাংকে কোটি কোটি টাকার এফডিআর, রাজধানীর গুলশানে নিজ নামে একটি ও স্ত্রীর নামে দুটি বিলাসবহুল আবাসিক ফ্ল্যাটের মালিকানা, রাজধানীর বসুন্ধরা আবাসিক এলাকায় ১০ কাঠার তিনটি প্লটসহ আরও অনেক সম্পদ।
অভিযোগে আরও জানা যায়, নিজ সার্কেলের অধীন মিরপুর, সাভার, মানিকগঞ্জ ও গাজীপুর গণপূর্ত বিভাগের প্রতিটি বড় কাজ, যেমন গাজীপুরের পূবাইলে থানা ভবন নির্মাণ (ই-জিপি দরপত্র আইডিঃ ১১৭৮৫৩৫, প্রাক্কলিত মূল্য ১৬ কোটি টাকা), গাজীপুরে সদর থানা ভবন নির্মাণ (ই-জিপি দরপত্র আইডিঃ ১১৮৪৩৯৮, প্রাক্কলিত মূল্যঃ ২২ কোটি টাকা) ,গাজীপুরে কালিয়াকৈর থানা ভবন নির্মাণ (ই-জিপি দরপত্র আইডিঃ ১১৮৪৩৯৭, প্রাক্কলিত মূল্যঃ ১১ কোটি টাকা) , গাজীপুর জেলা মডেল মসজিদ নির্মাণ (ই-জিপি আইডিঃ ১১৮৩৫২৩, প্রাক্কলিত মূল্যঃ ২০ কোটি টাকা), গাজীপুরে র্যাব ফোর্সেস ট্রেনিং স্কুল নির্মাণ প্রকল্পের ১৬০০ ও ৮০০ বঃফুট স্টাফ কোয়ার্টার, সুইমিং পুল, সাব-স্টেশন ভবন নির্মানের অবশিষ্ট কাজ ( ই-জিপি দরপত্র আইডি ১০০৮২০৭, প্রাক্কলিত মূল্য ৮ কোটি টাকা), গাজীপুরে জাতীয় কৃষি প্রশিক্ষন কেন্দ্র (নাটা) তে ০৬ তলা লেডিস হোস্টেল নির্মাণ (ই-জিপি দরপত্র আইডি ১০২৫০৩৮, প্রাক্কলিত মূল্য ১৫ কোটি টাকা) , মানিকগঞ্জের সিঙ্গাইরে মডেল মসজিদ নির্মাণ (ই-জিপি দরপত্র আইডি ১০৫৮৬৭০, প্রাক্কলিত মূল্য ১৪ কোটি টাকা) , জাতীয় কৃষি প্রশিক্ষন কেন্দ্র , গাজীপুরে ০২ তলা ক্যাফেটেরিয়া ভবন নির্মাণ (ই-জিপি দরপত্র আইড
এছাড়াও তিনি নিজের সার্কেলের বাইরেও ঢাকা সহ সারা বাংলাদেশে গণপূর্ত অধিদপ্তরের প্রতিটি বড় দরপত্র হতে ১% কমিশন গ্রহন করেন নতুবা উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে দরপত্রের বিষয়ে অভিযোগ করার ভয় দেখান। তার দপ্তরের অধীন প্রতিটি গণপূর্ত বিভাগের প্রতিটি মেরামত ও রক্ষণাবেক্ষন কাজ হতে ৫% হারে কমিশন গ্রহন করেছেন এবং এগুলো থেকে ৫ কোটি টাকারও অধিক টাকা সংগ্রহ করেছেন। তিনি গণপূর্ত অধিদপ্তরের প্রধান প্রকৌশলীর দপ্তরের স্মারক নং ২৫.৩৫.০০০০.২১৫.১৯.১০৭.১১-১৪২৮, তারিখঃ ০৪/১১/২০২৫ এর মাধ্যমে ই/এম গণপূর্ত জোনে ৭ জন নির্বাহী প্রকৌশলীর বদলী হয়েছে, যেগুলোর প্রতিটি থেকে ১ কোটি টাকা করে মোট ৭ কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন। গণপূর্ত অধিদপ্তরের প্রধান প্রকৌশলীর দপ্তরের স্মারক নং ২৫.৩৬.০০০০.২১৫.১৯.১০৪.২৪-১৫১৫, (তারিখঃ ১৭/১১/২০২৫)-এর মাধ্যমে ঢাকায় বিভিন্ন গণপূর্ত উপ-বিভাগে ৫ জন উপ-বিভাগীয় প্রকৌশলীর বদলী হয়েছে, যেগুলোর প্রতিটি থেকে ৩০ লাখ টাকা করে মোট ১.৫০ কোটি টাকা নিয়েছেন এই বদরুল আলম খান। গণপূর্ত অধিদপ্তরের প্রধান প্রকৌশলীর দপ্তরের স্মারক নং ২৫.৩৬.০০০০.২১৫.১৯.১০৩.২৪-১৫৮৫, তারিখঃ ২৫/১১/২০২৫ এর মাধ্যমে ঢাকা গণপূর্ত বিভাগ-৫ এ নির্বাহী প্রকৌশলীর পদায়ন হয়,
অপরদিকে, সম্প্রতি গণপূর্ত অধিদপ্তরের প্রধান প্রকৌশলী পরিবর্তন হবার পর থেকে ঢাকা, ঢাকার আশে পাশে সহ সারা দেশের সকল গুরুত্বপূর্ণ গণপূর্ত বিভাগ এর নির্বাহী প্রকৌশলি ও উপ-বিভাগীয় প্রকৌশলী পদে মন্ত্রণালয়ের উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে পদায়নের জন্য গণপূর্ত অধিদপ্তরের অনেক অফিসারের কাছ থেকে টাকা সংগ্রহ করেছেন বদরুল আলম খান এবং ক্রমাগতভাবে এসব অফিসারকে পদায়নের চেষ্টা করে যাচ্ছেন। সাভার সার্কেল গণপূর্তের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী মো. বদরুল আলম খানের সকল অপরাধ নিবিড় তদন্তপূর্বক দৃষ্টান্তমূলক শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করার জন্য দুদককে অনুরোধ জানানো হয়েছে।





