চড়া দামে নিম্নমানের খাবার সরসরবরাহ
সাবেক কর্মকর্তাদের সিন্ডিকেটের নিয়ন্ত্রণে রেলওয়ের ক্যাটারিং

রেলওয়ের ক্যাটারিং থেকে যাত্রীদের কাছে চড়া দামে নিম্নমানের খাবার সরবরাহের অভিযোগ দীর্ঘ দিনের। ক্যাটারিং থেকে যে খাবার দেওয়া হয় অনেক সময় সেটা থাকে খাওয়ার অযোগ্য। নিরুপায় যাত্রীরা ভ্রমণের সময় চড়া দামে খাবার কিনতে বাধ্য হন। যার নিয়ন্ত্রণে রয়েছে সাবেক কর্মকর্তাদের প্রভাবশালী সিন্ডিকেট। সম্প্রতি দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)সহ বিভিন্ন দপ্তরে এসব বিষয়ে বেশকিছু অভিযোগও জমা হয়েছে কিন্তু কোন প্রতিকার মিলছে না। এসব বিষয়ে মুখ খুলতে চাইছেন না বাংলাদেশ রেলওয়ে ও রেলপথ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা।
বাংলাদেশ রেলওয়েতে ক্যাটারিং বাণিজ্য করে বছরে সরকারের প্রায় ৭ কোটি টাকা রাজস্ব আত্মসাতের অভিযোগে আনা হয় সাবেক অতিরিক্ত মহাপরিচালক (অপারেশন) মো. মিয়া জাহান, সাবেক যুগ্ন মহাপরিচালক (অপারেশন) রশিদা সুলতানা গণি ও সাবেক উপপরিচালক (মার্কেটিং) কালিকান্ত ঘোষসহ সাবেক কর্মকর্তাদের সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে। কিন্তু দৃশ্যত তাদের বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ ২০১৯ সালে ‘বাংলাদেশ রেলওয়ে ক্যাটারিং অ্যান্ড টুরিজম সেল’ নামে একটি সেল গঠন করে। এর আওতায় বিভিন্ন ট্রেনে খাবার সরবরাহ করা হয়। শুরু থেকেই এরনিয়ন্ত্রণ নেয় সাবেক কর্মকর্তাদের একটি সিন্ডিকেট। সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে নানান অভিযোগ উঠার পর; প্রায় দুই বছর আগে রেল মন্ত্রণালয় একজন অতিরিক্ত সচিবের নেতৃত্বে ‘বাংলাদেশ রেলওয়ে ক্যাটারিং অ্যান্ড ট্যুরিজম কোম্পানি লিমিটেড’ গঠনের উদ্যোগ নেয়। কিন্তু সিন্ডিকেটের বাঁধার কারনে এখনো কোম্পানী গঠন করা হয়নি বলে সংশ্লিষ্টরা অভিযোগ করেছেন।
আরও পড়ুন: প্রথমবার বাংলাদেশে তৈরি হবে রপ্তানীমুখী ড্রোন, জমি নিতে বেপজার সঙ্গে চুক্তি সম্পন্ন
দুদকসহ বিভিন্ন দপ্তরে অভিযোগ থেকে জানা যায়, ‘বাংলাদেশ রেলওয়ে ক্যাটারিং অ্যান্ড ট্যুরিজম সেল’ মূলত: রেলওয়ের বাণিজ্যিক ও অপারেশন বিভাগের সাবেক ও বর্তমান কর্মকর্তারা নিয়ন্ত্রণ করেন। সেলটি পরিচালনার দায়িত্বে রয়েছেন সাবেক উপপরিচালক (মার্কেটিং) কালিকান্ত ঘোষ। তিনি নির্দিষ্টহারে মাসোহারা দিয়ে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে ‘ম্যানেজ’ করে রাখেন। সেলটি পরিচালনা করা হয় অপেশাদার লোকজন দিয়ে। বেয়ারা ও ম্যানেজার পদে যাদের নিয়োগ দেওয়া হয়েছে তাদের কাছ থেকেও আদায় করা হয়েছে মোটা অংকের অর্থ। রেলওয়ের পূর্বাঞ্চলে ঢাকা-চট্টগ্রাম রুটে সোনার বাংলা এক্সপ্রেস, পশ্চিমাঞ্চলের ঢাকা-রাজশাহী রুটের বনলতা এক্সপ্রেস, ঢাকা-বেনাপুল রুটের বেনাপোল এক্সপ্রেস, ঢাকা-পঞ্চগড় রুটের পঞ্চগড় এক্সপ্রেস, ঢাকা-কুড়িগ্রাম রুটের কুড়িগ্রাম এক্সপ্রেস, ঢাকা-চিলাহাটি রুটের চিলাহাটি এক্সপ্রেস এই ৬ টি ট্রেন, খুলনা ও কমলাপুরে রেলওয়ের আবাসিক হোটেল এবং ক্যাটারিং পরিচালনা করছে এই সেল। তারা সেল পরিচালনার জন্য কোন টেন্ডারেও অংশ নেননি।
অভিযোগে বলা হয়, বিভিন্ন ট্রেন থেকে কালীকান্ত ঘোষ প্রতিমাসে নির্দিষ্ট হারে টাকা নেন। এরমধ্যে সোনার বাংলা এক্সপ্রেস থেকে ৪ লাখ টাকা, বনলতা থেকে ৩ লাখ, পঞ্চগড় এক্সপ্রেস, কুড়িগ্রাম এক্সপ্রেস ও বেনাপোল এক্সপ্রেস থেকে ২ লক্ষ টাকা নেন কালিকান্ত ঘোষ। বছরে তিনি ৬টি ট্রেন থেকে প্রায় দুই কোটি টাকা আদায় করলেও শুধু লাইসেন্স ফি বাবদ বছরে মাত্র ৪ লাখ টাকা রেলওয়েকে জমা দেন। বাকী টাকা নিজেদের মধ্যে ভাগাভাগি করেন। কালীকান্ত ঘোষ প্রায় দুই বছর আগে অবসরে গেলেও এখনো এখনো ক্যাটারিং ব্যবসা রেলওয়ে ক্যাটারিং সেলের নাম ব্যবহার করে ব্যবসা করেন। তার সহযোগী ছিলেন সাবেক মহাপরিচালক জি ডি এন মজুমদার ও সাবেক অতিরিক্ত মহাপরিচালক (অপারেশন) মো. মিয়া জাহান। অবসরে যাওয়ার পরও তারা চুক্তিভিত্তিকভাবে নিজেদেরকে ক্যাটারিং ব্যবসায় সম্পৃক্ত রয়েছেন।
আরও পড়ুন: মিরপুর বাংলা কলেজের সামনে যা হচ্ছে
অভিযোগের তথ্য মতে, সিন্ডিকেটের সদস্যরা রেলওয়েতে ‘ক্যাটারিং বেয়ারা’ নিয়োগ দেওয়ার নামে ১ থেকে দেড় লাখ টাকা করে আদায় করেন। প্রায় দেড়শ ক্যাটারিং বেয়ারাকে ‘সরকারি চাকরি’ দেওয়ার কথা এই অর্থ আদায় করে সিন্ডিকেট। বিভিন্ন ট্রেনে ক্যাটারিং ম্যানেজার নিয়োগের জন্য প্রত্যেকের কাছ থেকে নেন ৫ লাখ টাকা করে।
রেলওয়ে ক্যাটারিং সার্ভিসে সিন্ডিকেটের নিয়ন্ত্রণ প্রসঙ্গে জানার জন্য রেলপথ মন্ত্রণালয়ের সচিব ড. হুমায়ুন কবির ও রেলওয়ের অধিদপ্তরের মহাপরিচালক কামরুল আহসানের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তারা কোন বক্তব্য দেননি। তাদের হোয়াটসঅ্যাপ নম্বরে বার্তা দেওয়ার পর তারা সেটি দেখেন এবং পড়েন। কিন্তু কোন জবাব দেননি।
এবিষয়ে সিন্ডিকেটের নিয়ন্ত্রক হিসেবে পরিচিত সাবেক উপপরিচালক (মার্কেটিং) কালিকান্ত ঘোষ বলেন, আমি এখন অবসরে আছি। আগে ক্যাটারিং সেল দেখাশোনা করতাম। বর্তমানে আমার সঙ্গে রেলওয়ে ক্যাটারিং অ্যান্ড ট্যুরিজম সেলের সম্পৃক্ততনেই।