বোয়ালমারী–মধুখালীর ‘গডফাদার’ খন্দকার নাসির
ফরিদপুরের আলফাডাঙ্গা উপজেলা আওয়ামী লীগের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিবিষয়ক সম্পাদক মিয়া আসাদুজ্জামান একই সঙ্গে উপজেলা বিএনপির সহ-সভাপতি। একই উপজেলার কৃষক লীগের সহ-সভাপতি মাসুদ মাস্টারও বিএনপির সহ-সভাপতির পদ বাগিয়ে নিয়েছেন। ফরিদপুর–১ আসনের বোয়ালমারী, মধুখালী ও আলফাডাঙ্গার সদ্য ঘোষিত বিএনপির কমিটিতে এমন ৭০ জন পদ পেয়েছেন, যারা এখনো আওয়ামী লীগ ও এর অঙ্গসংগঠনের বিভিন্ন পদে রয়েছেন।
আর এই সুযোগ করে দিয়েছেন ফরিদপুর–১ আসনে বিএনপির মনোনয়ন–প্রত্যাশী ও কৃষক দলের সহ-সভাপতি খন্দকার নাসিরুল ইসলাম নাসির। তাঁর বিরুদ্ধে কমিটি বাণিজ্য, সন্ত্রাস, চাঁদাবাজি, দখলবাজিসহ অসংখ্য অভিযোগে বিএনপির একটি শক্তিশালী অংশ প্রতিদিনই সভা, সমাবেশ ও মশাল মিছিল করছে।
আরও পড়ুন: অমানবিক পুশইনের শিকার অন্তঃসত্ত্বা ভারতীয় নারী সোনালী খাতুনকে বিএসএফের কাছে হস্তান্তর করলো বিজিবি
তাদের অভিযোগ—টাকার বিনিময়ে আওয়ামী লীগ নেতাদের বিএনপিতে ভিড়ানো, মামলা বাণিজ্য, টিসিবির ডিলার বণ্টনে অনিয়ম, সরকারি খাল–বিল দখল—এমন কোনো ক্ষেত্র নেই যেখানে নাসিরের হস্তক্ষেপ নেই। এমনকি নিজ দলের নেতা–কর্মীদের ওপর হামলা, দলীয় কার্যালয়ে আগুন, দলের চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া ও ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের ছবিতে অগ্নিসংযোগ, সন্ত্রাস ও চাঁদাবাজিতেও তিনি জড়িত বলে অভিযোগ রয়েছে তাঁর বিরুদ্ধে।
জানা গেছে, ত্যক্ত–বিরক্ত নেতাকর্মীরা তাঁর বিরুদ্ধে একাধিকবার দলীয় প্রধানের কাছে লিখিত অভিযোগ দিয়েছেন। এলাকায় তাঁর বিরুদ্ধে ঝাড়ু মিছিল হয়েছে। দলীয় শৃঙ্খলাভঙ্গের অভিযোগে ছয়বার বহিষ্কৃত হয়েছেন খন্দকার নাসির।
আরও পড়ুন: জামালপুরের আলোচিত মনিরুল হত্যা মামলার এজাহারভুক্ত আসামি ব্রাহ্মণবাড়িয়া থেকে গ্রেফতার
ভাড়াটে সন্ত্রাসী দিয়ে বিএনপির নেতাকর্মীদের ওপর হামলা
গত ৭ নভেম্বর বোয়ালমারীতে বিএনপির একটি অংশের জাতীয় বিপ্লব ও সংহতি দিবসের অনুষ্ঠানে হামলা চালায় একদল লোক। অভিযোগ, হামলাকারীরা খন্দকার নাসিরের ভাড়াটে সন্ত্রাসী। তাদের হামলায় বেশ কয়েকজন নেতাকর্মী গুরুতর আহত হন। এমনকি দলীয় কার্যালয়, খালেদা জিয়া ও তারেক রহমানের ছবিতে অগ্নিসংযোগের অভিযোগও ওঠে খন্দকার নাসিরের বিরুদ্ধে। এ ঘটনায় দায়ের হওয়া মামলায় তিনি ১ নম্বর আসামি।
ওই হামলায় গুরুতর আহত বোয়ালমারী উপজেলা যুবদলের আহ্বায়ক ও পৌরসভার কমিশনার মিনাজুর রহমান লিপন বলেন, ‘বিপ্লব ও সংহতি দিবস উপলক্ষে র্যালি ও সভার প্রস্তুতি নিয়ে আসার পথে আমাদের ওপর গডফাদার নাসিরের ভাড়াটে সন্ত্রাসীরা হামলা চালায়।’
মিনাজুর রহমান লিপন জানান, রামদা দিয়ে কুপিয়ে তাকে রক্তাক্ত করা হয়, তাঁর মাথায় ৩৬টি সেলাই লাগে। এ ছাড়া সন্ত্রাসীরা তাঁর দুই হাত ভেঙে দেয়। দলীয় কার্যালয়ে ভাঙচুর ও আগুন এবং ১০–১৫টি মোটরসাইকেল পুড়িয়ে দেওয়া হয় বলে জানান তিনি।
বোয়ালমারী উপজেলা যুবদলের আহ্বায়ক আক্ষেপ করে বলেন, ‘বছরের পর বছর আওয়ামী লীগের অত্যাচার সহ্য করেছি। ভেবেছিলাম এখন একটু শান্তিতে বাঁচব। কিন্তু নাসিরের কারণে এলাকায় আরও ভয়ের পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে।’
এ ছাড়া গত ১৪ আগস্ট মধুখালী উপজেলার রায়পুর ইউনিয়নের দিঘলিয়া এলাকায় বোয়ালমারী উপজেলা বিএনপির সাবেক যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক শামসুদ্দিন মিয়া ঝুনুর মিছিল ও গাড়িবহরে হামলা চালিয়ে বেশ কয়েকজনকে আহত ও বেশ কয়েকটি গাড়ি ভাঙচুর করার অভিযোগ রয়েছে খন্দকার নাসিরের সমর্থকদের বিরুদ্ধে।
টাকার বিনিময়ে আওয়ামী লীগ নেতাদের বিএনপিতে পদ
ফরিদপুর–১ আসনের তিন উপজেলা ও পৌর বিএনপির সদ্য ঘোষিত কমিটিতে অন্তত ৭০ জন আওয়ামী লীগ ও অঙ্গসংগঠনের পদধারীকে পদ দেওয়ার অভিযোগ রয়েছে নাসিরের বিরুদ্ধে। আর এতে বিপুল অর্থ লেনদেন হয়েছে বলে ব্যাপক প্রচার আছে।
দলীয় সূত্রে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, আলফাডাঙ্গা উপজেলা আওয়ামী লীগের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি সম্পাদক মিয়া আসাদুজ্জামানকে বিএনপির সহ-সভাপতি করা হয়েছে, যিনি ২০২১ সালের ইউপি নির্বাচনে নৌকা প্রতীক পেয়ে চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। একইভাবে আওয়ামী লীগের কার্যনির্বাহী সদস্য আব্দুল ওহাব পান্নুকে করা হয়েছে উপজেলা বিএনপির সহ-সভাপতি।
অবৈধ সম্পদ অর্জন ও ক্ষমতার অপব্যবহার, ছাত্র–জনতা হত্যার একাধিক অভিযোগে বর্তমানে কারাগারে থাকা সাবেক ডিএমপি কমিশনার আছাদুজ্জামান মিয়ার শ্যালক নুরুল ইসলাম লিটন, যিনি আওয়ামী লীগের ঘনিষ্ঠ ছিলেন এবং এলাকায় আছাদুজ্জামান মিয়ার সম্পদের দেখভাল করেন, তাকেও বিএনপির কমিটিতে সদস্য করা হয়েছে।
বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে হামলার ঘটনায় দায়ের করা তিন মামলার আসামি লিটনের ছোট ভাই ঢাকা মহানগর দক্ষিণ শ্রমিক লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক হারিসুর রহমান সোহানও বর্তমানে কারাগারে রয়েছেন। আছাদুজ্জামান মিয়ার ঘনিষ্ঠ মনিরুজ্জামান মনির ওরফে মনি, যিনি গত জাতীয় নির্বাচনে আওয়ামী লীগ প্রার্থী আব্দুর রহমানের হয়ে নৌকার পক্ষে ব্যাপক প্রচারণা চালান এবং বাড়ি বাড়ি গিয়ে নৌকার পক্ষে ভোট কিনেছিলেন, তাকেও বসানো হয়েছে উপজেলা বিএনপির সহ–সাধারণ সম্পাদকের পদে।
উপজেলা কৃষক লীগের সহ-সভাপতি মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান ওরফে মাসুদ মাস্টারকে দেওয়া হয়েছে উপজেলা বিএনপির সহ-সভাপতির পদ। আলফাডাঙ্গা ইউনিয়ন যুবলীগের প্রচার সম্পাদক মো. জাকার মেম্বারকেও কমিটিতে সহ–সমবায় বিষয়ক সম্পাদক করা হয়েছে।
গোপালপুর ইউনিয়ন কৃষক লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক মো. ওহিদ শিকদার মেম্বারকে দেওয়া হয়েছে সহ–সাংগঠনিক সম্পাদকের পদ এবং বর্তমান গোপালপুর ইউনিয়ন কৃষক লীগের সাধারণ সম্পাদক ইব্রাহিম মেম্বারকে দেওয়া হয়েছে কোষাধ্যক্ষ পদ।
এ ছাড়া আলফাডাঙ্গা পৌর বিএনপির ১০১ সদস্য বিশিষ্ট কমিটিতে ফরিদপুর জেলা স্বেচ্ছাসেবক লীগের কার্যনির্বাহী সদস্য, আলফাডাঙ্গা উপজেলা স্বেচ্ছাসেবক লীগের সহ-সভাপতি কামরুজ্জামান কদরকে প্রচার সম্পাদক করা হয়েছে।
বোয়ালমারীর আওয়ামী লীগ নেতা মিজানুর রহমান ওরফে সোনা মিয়া। স্থানীয়রা তাকে সাবেক ডিবি প্রধান হারুন–অর–রশীদের ‘ক্যাশিয়ার’ হিসেবে চেনেন। তাকে উপজেলা বিএনপির স্থানীয় সরকারবিষয়ক সম্পাদক করা হয়েছে। অমিত সাহা, যিনি আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য আব্দুর রহমানের ঘনিষ্ঠ ছিলেন, তাকে দেওয়া হয়েছে উপজেলা বিএনপির কোষাধ্যক্ষ।
তাছাড়া বোয়ালমারী উপজেলার দাদপুর ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের বর্তমান কমিটির সভাপতি মওলা বিশ্বাসকে উপজেলা বিএনপির সদস্য করা হয়েছে। একই ইউনিয়ন যুবলীগের সহ-সভাপতি সাইফুল ইসলাম বকুলকে উপজেলা বিএনপির সদস্য এবং উপজেলা শ্রমিক লীগের সহ-সভাপতি হরেন কুমার কৃষ্ণকে করা হয়েছে পৌর বিএনপির সদস্য। সাতৈর ইউনিয়ন যুবলীগের সাবেক সদস্য গোপাল সাহা এখন উপজেলা বিএনপির সহ-কোষাধ্যক্ষ।
মধুখালী উপজেলা বিএনপির কমিটিতে বাংলাদেশ মহিলা আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক মাহমুদা বেগম কৃকের ঘনিষ্ঠ এবং ফ্যাসিস্ট আমলে মধুখালী পৌরসভা থেকে আওয়ামী লীগ মনোনীত নির্বাচিত মহিলা কাউন্সিলর নাজমা সুলতানাকে বিএনপির উপজেলা কমিটির মহিলা বিষয়ক সম্পাদক করা হয়েছে। আর আওয়ামী লীগের সক্রিয় কর্মী হিসেবে পরিচিত মিলন মোল্লা পেয়েছেন সহ–দপ্তর সম্পাদকের পদ।
আওয়ামী লীগের আরেক কর্মী রায়হান মোল্লাকে পৌর বিএনপির কোষাধ্যক্ষ পদে বসানো হয়েছে। আওয়ামী লীগ কর্মী মিরাজুল ইসলাম মিল্টনকে করা হয়েছে উপজেলা কমিটির সহ-সভাপতি। আওয়ামী লীগের সক্রিয় কর্মী হিসেবে পরিচিত আনোয়ার হোসেন এখন উপজেলা বিএনপির সদস্য।
এভাবে তিন উপজেলার নানা স্তরে আওয়ামী লীগের নেতাদের বিএনপির কমিটির গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে বসানো হয়েছে।
ত্যাগী নেতাদের ক্ষোভ
২৩ অক্টোবর ঘোষিত তিন উপজেলা ও পৌর বিএনপির বিতর্কিত নতুন কমিটি প্রকাশের পর থেকেই ত্যাগী ও নির্যাতিত নেতাকর্মীদের মধ্যে তীব্র ক্ষোভ দেখা দেয়। ২৫ অক্টোবর বোয়ালমারীতে বিক্ষোভ ও মশাল মিছিল, ৩০ অক্টোবর বিক্ষোভ ও সড়ক অবরোধ, ২৬ ও ২৮ অক্টোবর আলফাডাঙ্গায় মশাল মিছিলসহ প্রায় প্রতিদিনই কমিটি বাতিল ও নাসিরকে অপসারণের দাবি জানিয়ে ধারাবাহিক কর্মসূচি পালন করছেন নেতাকর্মীরা। তাদের অভিযোগ—খন্দকার নাসির আওয়ামী লীগপন্থীদের দিয়ে কমিটি গঠন করে বিএনপির ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ করেছেন। বিতর্কিতদের বাদ দিয়ে ত্যাগী নেতাদের মাধ্যমে দল পুনর্গঠন করার দাবি জানাচ্ছেন তারা।
সাধারণ মানুষ ও দলীয় নেতাদের সঙ্গে দুর্ব্যবহার
খন্দকার নাসিরের বিরুদ্ধে বহুল প্রচলিত অভিযোগ হলো—সাধারণ মানুষ ও দলের নেতাকর্মীদের সঙ্গে তাঁর খারাপ ব্যবহার, অশ্রাব্য ভাষায় গালাগাল, দলীয় নেতাকর্মীদের অপমান। এসব নিয়ে অভিযোগ–অনুযোগ কম হয়নি। তাঁর এসব কর্মকাণ্ডের কয়েকটি ঘটনা এই প্রতিবেদকের কাছে তুলে ধরেন নেতাকর্মীরা।
বোয়ালমারী মহিলা কলেজের পরিচালনা পর্ষদের সভাপতি থাকাকালে তাঁর এমন অনাকাঙ্ক্ষিত কাণ্ডের একটি ভিডিও তখন ভাইরাল হয়। তাতে দেখা যায়, তাঁর কাছে কলেজের শিক্ষার্থীরা অধ্যক্ষ ফরিদের নানা অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ জানালে তিনি উল্টো শিক্ষার্থীদের মারতে উদ্যত হন এবং অনুষ্ঠান থেকে বের করে দেন।
গত ৩০ অক্টোবর এক জনসভায় খন্দকার নাসির বিএনপির সাবেক মহাসচিব ওবায়দুর রহমান এবং বর্তমান আন্তর্জাতিক বিষয়ক কমিটির সদস্য শামা ওবায়েদকে নিয়ে কুরুচিপূর্ণ মন্তব্য করেন। এই ঘটনার প্রতিবাদে ৪ নভেম্বর বিক্ষোভ মিছিল ও প্রতিবাদ সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয় নাসিরের বিরুদ্ধে। এতে বিএনপি ও সহযোগী সংগঠনের বহু নেতাকর্মী অংশ নেন। সমাবেশে বক্তারা বলেন—খন্দকার নাসিরুল ইসলাম আওয়ামী লীগের সঙ্গে আঁতাত করে স্থানীয় বিএনপিকে দুর্বল করার অপচেষ্টা চালাচ্ছেন। নাসিরুল ইসলামকে অবিলম্বে দল থেকে বহিষ্কার করে বোয়ালমারী, মধুখালী ও আলফাডাঙ্গা এলাকা থেকে প্রত্যাহার করার জন্য ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের প্রতি দাবি জানান।
তাছাড়া গত ১১ অক্টোবর আলফাডাঙ্গায় একটি অনুষ্ঠানে উপজেলা বিএনপির সভাপতি আব্দুল মান্নান আব্বাসকে প্রকাশ্যে ‘ফাউল’ বলে ধমক দেন খন্দকার নাসির। পথসভায় বক্তব্য না শুনে চলে যাওয়া সাধারণ মানুষকেও ‘বেয়াদব’ বলে অভিহিত করেন। তাঁর একাধিক ভিডিও সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে।
চাঁদাবাজি ও দখলবাজির অভিযোগ
৫ আগস্ট গণঅভ্যুত্থানের পর হঠাৎ বিলাসবহুল প্রাডো গাড়ি ব্যবহার শুরু করেন খন্দকার নাসির। গাড়িটি সাতৈর ইউনিয়নের এক ব্যবসায়ীর কাছ থেকে ভয়ভীতি দেখিয়ে আদায় করেছেন বলে অভিযোগ আছে।
গত ৪ নভেম্বর কে এইচ কে লিমিটেডের চেয়ারম্যান আব্দুল আউয়াল খন্দকার অভিযোগ করেন—তাঁর প্রতিষ্ঠানের ১০ একর ৫৮ শতাংশ জমি খন্দকার নাসির ও তাঁর ভাই নাজিরুলের নেতৃত্বে দখল করা হয়েছে। নাসিরের নির্বাচনী খরচের জন্য তাঁর (আউয়াল) কাছে ২০ লাখ টাকা চাঁদার চাওয়া হয়। কিশোর–হেলমেট বাহিনী দিয়ে মারধর করা হয় তাঁর কর্মীদের। পুলিশকে জানালেও ব্যবস্থা নেয়নি।
এক সাংবাদিকের বাড়িতে হামলা, ভাঙচুর ও প্রাণনাশের হুমকির অভিযোগও রয়েছে নাসিরের বিরুদ্ধে। সাংবাদিক খন্দকার আব্দুল্লাহ তুষার জানান, তাঁর বাড়িতে হামলা করে সিসি ক্যামেরা ও আসবাব ভাঙচুর, নগদ ৫০ হাজার টাকা ও একটি ডিএসএলআর ক্যামেরা লুট করে। তাঁর মা-ও নিগৃহীত হন হামলায়।
খন্দকার নাসিরের বিরুদ্ধে তিন উপজেলার বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রধানের কাছ থেকে মোটা অঙ্কের টাকা নেওয়ার অভিযোগও উঠে আসছে একে একে। মূলত গত বছরের ৫ আগস্টের আগে যারা নিয়োগ পেয়েছেন, এমন শিক্ষকদের মামলা ও ‘মব’ সৃষ্টির ভয় দেখিয়ে তাদের কাছ থেকে অর্থ নিয়েছেন তিনি। এ নিয়ে একাধিক শিক্ষক কথা বলেছেন এই প্রতিবেদকের সঙ্গে।
বোয়ালমারীর একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রধান শিক্ষক নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘নাসির আমাকে ভয়ভীতি দেখিয়ে পাঁচ লাখ টাকা নিয়েছে। তিনি (নাসির) হুমকি দিয়েছেন—এখানে চাকরি করতে হলে আমাকে টাকা দিতে হবে। যদি না দেই তাহলে মব সৃষ্টি করে পুলিশ দিয়ে গ্রেপ্তার করাবে। এবং শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে বের করে দেবে। একই সঙ্গে বৈষম্যবিরোধী মামলায় ফাঁসিয়ে দেবে। পরে তাঁর চাহিদা অনুযায়ী টাকা দিয়েছি।’
এলাকায় আলোচনা আছে—আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য এবং দেশ–পলাতক সাবেক মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রী আব্দুর রহমানের সঙ্গে গভীর সম্পর্ক রয়েছে খন্দকার নাসিরুল ইসলামের। গণঅভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর আব্দুর রহমানের শত কোটি টাকার ইটভাটা ও তাঁর বাড়ির সম্পদ রক্ষায় নাসিরের অনুসারীদের ভূমিকার কথা প্রচলিত। মাঝে আব্দুর রহমানের সঙ্গে বনিবনায় সমস্যা তৈরি হলে নাসির মানববন্ধন করান; পরে অর্থের বিনিময়ে সম্পর্ক আবার ঠিক হয়।
আরও অভিযোগ আছে, সরকার পতন–পরবর্তী সময়ে আব্দুর রহমানের সঙ্গে সরাসরি দেখা করেন খন্দকার নাসির ও তাঁর ভাই খন্দকার নাজিরুল ইসলাম।
‘গাইছো নাসির মাইছো নাসির’
খন্দকার নাসিরকে নিয়ে রসাত্মক ও ঘৃণাসূচক একটা বচন বেশ প্রচলিত এলাকায়—‘গাইছো নাসির মাইছো নাসির’। এই বচনের উৎপত্তি সম্পর্কে স্থানীয়দের ভাষ্যে জানা যায় নাসিরের দুটি দখলকাণ্ডের কথা।
এর একটি হলো বিল চাপাদহ। এই বিলে মাছ ধরে জীবন নির্বাহ করতেন জেলেরা। কিন্তু নাসির ও তাঁর সহযোগী দেলোয়ার হোসেন চাপাদহ বিল দখল করে অসহায় জেলেদের জীবন দুর্বিষহ করে তোলেন বলে অভিযোগ। আর মাত্র তিন মাস এমপি থাকাকালে সরকারি শত শত গাছ কেটে বিক্রির অভিযোগ রয়েছে নাসিরের বিরুদ্ধে। সরকারি গাছ ও বিল–নদীর মাছ ধরে বিক্রির কারণে তাঁর নাম হয়ে যায়—‘গাইছো নাসির’, ‘মাইছো নাসির’।
ধানের শীষের পক্ষে কখনো কাজ করেননি নাসির
খন্দকার নাসিরের রাজনীতির শুরুটা জাসদ ছাত্রলীগে। পরে জাতীয় পার্টি, আওয়ামী লীগ হয়ে এখন বিএনপিতে। বর্তমানে তিনি কৃষক দলের সহ-সভাপতি।
স্থানীয় নেতাকর্মীদের কাছ থেকে জানা গেছে, ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠিত ষষ্ঠ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপির প্রার্থীর বিরোধিতা করে হাতি প্রতীকে স্বতন্ত্র সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন খন্দকার নাসির। মাত্র তিন মাস পর অনুষ্ঠিত সপ্তম জাতীয় নির্বাচনে বিএনপি থেকে মনোনয়ন পেলেও ভোট পান মাত্র ৩,৯৮৪টি এবং জামানত হারান তিনি।
এরপর আর কখনো ধানের শীষের পক্ষে কাজ করেননি খন্দকার নাসির। ২০০৮ সালে শাহ মো. আবু জাফর ধানের শীষ পেলে নাসির কাজ করেন কাজী সিরাজুল ইসলামের কলস প্রতীকের পক্ষে। একইভাবে ২০০১ সালে আবু জাফর চারদলীয় জোটের প্রার্থী হলে নাসির অর্থের বিনিময়ে নৌকা প্রতীকের প্রার্থী কাজী সিরাজুল ইসলামের পক্ষে কাজ করেন বলে জানান স্থানীয় নেতাকর্মীরা।
বোয়ালমারী পৌর বিএনপির সাবেক সদস্য সচিব আমিনুল ইসলাম আলাপকালে বলেন, নাসিরের নানা অপকর্মের কারণে বিরক্ত স্থানীয় বিএনপি ও অঙ্গসংগঠনের নেতাকর্মীরা। সাংবাদিক নির্যাতন থেকে শুরু করে স্থানীয় ত্যাগী ও পরীক্ষিত নেতাদের বাদ দিয়ে আওয়ামী লীগের নেতা–কর্মীদের দলে ভেড়ানো, কমিটি বাণিজ্য, সন্ত্রাস ও চাঁদাবাজির মাধ্যমে সংগঠনে বিভাজন সৃষ্টি করেছেন নাসির।
নাসিরের কর্মকাণ্ডে দীর্ঘদিনের ত্যাগী ও নির্যাতিত নেতারা উপেক্ষিত, বাড়ছে ক্ষোভ ও বিভক্তি—এমন মন্তব্য করে আমিনুল ইসলাম বলেন, তাই তো ২২ মে আলফাডাঙ্গা উপজেলা বিএনপির দলীয় কার্যালয়ে একটি সভায় নাসিরুল ইসলামকে তালাবদ্ধ করে রাখে বিক্ষুব্ধ নেতাকর্মীরা। পরে পুলিশের সহযোগিতায় দুই ঘণ্টা পর তাকে উদ্ধার করা হয়।
এভাবেই বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল বিএনপির নেতা পরিচয়ে দীর্ঘদিন ধরে স্ববিরোধী কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে এক বিতর্কিত চরিত্রে পরিণত হয়েছেন খন্দকার নাসিরুল ইসলাম। আর বেপরোয়া চাঁদাবাজি, দখল, হামলা–মামলার অবিরাম অভিযোগ তাঁর নামের আগে যোগ করেছে ‘গডফাদার’ তকমা।





