বাংলাদেশে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ান সোনালী ভবিষ্যৎ

Sanchoy Biswas
এম. এ. মতিন
প্রকাশিত: ৪:২৫ অপরাহ্ন, ১৮ জুলাই ২০২৫ | আপডেট: ৭:৪২ পূর্বাহ্ন, ১৪ অগাস্ট ২০২৫
ছবিঃ সংগৃহীত
ছবিঃ সংগৃহীত

ভূমিকাঃ-দুর্বলতা থেকে দৃঢ়তার পথে

একসময় যে বাংলাদেশকে দক্ষিণ এশিয়ার গরীব দেশ হিসেবে অবজ্ঞা করা হতো, আজ সেই বাংলাদেশই দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার একজন শক্তিশালী অর্থনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। দৃঢ় নেতৃত্ব, কর্মঠ জনগণ, ধারাবাহিক প্রবৃদ্ধি ও বৈশ্বিক সম্পর্কের শক্ত ভিতর ওপর ভর করে বাংলাদেশ এখন এক উদীয়মান টাইগারে পরিণত হচ্ছে ২১ শতকের বৈশ্বিক অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখার প্রস্তুতিতে।

আরও পড়ুন: গণ আকাঙ্ক্ষা বাস্তবায়নে হতাশার মুখোমুখি

যদিও রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব, দুর্নীতি এবং পরিবেশগত ঝুঁকি রয়েছে, তবুও বাংলাদেশের স্থিতিশীলতা, অভিযোজনক্ষমতা এবং সংস্কারের ইচ্ছাশক্তি প্রমাণ করে যে এই সোনালী ভবিষ্যৎ আর স্বপ্ন নয়—এটি এখন দৃশ্যমান বাস্তবতা।

I. সাফল্যের সূচকঃ-কেন ভবিষ্যৎ উজ্জ্বল

আরও পড়ুন: জম্মু-কাশ্মীর: আলাদা পরিচয় থেকে জাতীয় মূলধারায়

১. জিডিপি প্রবৃদ্ধির ধারাবাহিকতা

গত এক দশক ধরে বাংলাদেশ ধারাবাহিকভাবে ৬–৭% জিডিপি প্রবৃদ্ধি অর্জন করেছে।

কোভিড-১৯ এর ধাক্কা কাটিয়ে ২০২৪ সালে প্রবৃদ্ধি দাঁড়ায় ৫.৮%, এবং বিশ্বব্যাংকের পূর্বাভাস অনুযায়ী ২০২৫ সালে তা ৬.২% হবে।

দেশের নামমাত্র জিডিপি এখন $৪৬০ বিলিয়নের কাছাকাছি এবং ২০২৬ সালের মধ্যে $৫০০ বিলিয়ন অতিক্রম করবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।

২. রপ্তানি খাত ও বৈচিত্র্যতা

তৈরি পোশাক (RMG) খাত এখনো প্রধান চালিকাশক্তি, যা FY 2024 সালে $৪৭ বিলিয়ন রপ্তানি আয় এনেছে, মোট রপ্তানির ৮৪%।

আইসিটি, চামড়া, ওষুধ, কৃষিপণ্য ও সিরামিক খাতে বৈচিত্র্যতা বাড়ছে।

“মেইড ইন বাংলাদেশ” ব্র্যান্ড এখন কেবল পোশাকে সীমাবদ্ধ নয়—বিশ্বজুড়ে গ্রহণযোগ্যতা বাড়ছে।

৩. বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ

জুলাই ২০২৫ পর্যন্ত বাংলাদেশের মোট বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ দাঁড়িয়েছে $৩১.০০ বিলিয়ন।

মিতব্যয়ী আমদানি নীতি ও রেমিটেন্স প্রবাহ রিজার্ভ স্থিতিশীল রাখতে সহায়তা করছে।

আইএমএফ-এর $৪.৭ বিলিয়ন ঋণ কর্মসূচির আওতায় গৃহীত অর্থনৈতিক সংস্কারগুলো দীর্ঘমেয়াদে স্থিতিশীলতা আনছে।

৪. অবকাঠামো বিপ্লব

পরিবর্তন আনছে কিছু যুগান্তকারী মেগা প্রকল্প:

পদ্মা সেতু – দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের অর্থনৈতিক সম্ভাবনার দ্বার খুলে দিয়েছে।

ঢাকা মেট্রোরেল – শহরের যানজট কমিয়ে আনার নতুন দিগন্ত।

মাতারবাড়ি গভীর সমুদ্র বন্দর – নির্মাণাধীন, যা আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে বাংলাদেশকে নতুন উচ্চতায় নিয়ে যাবে।

রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্প – দেশের শক্তি খাতে বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনবে।

৫. ডিজিটাল বাংলাদেশ থেকে স্মার্ট বাংলাদেশের পথে

বর্তমানে ইন্টারনেট ব্যবহারকারী সংখ্যা ১২ কোটিরও বেশি।

আইসিটি খাতে রপ্তানি আয় $১.৫ বিলিয়নের বেশি।

ফ্রিল্যান্সার, স্টার্টআপ ও ই-গভর্নেন্সে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা প্রসারমান।

লক্ষ্য: ২০৪১ সালের মধ্যে স্মার্ট বাংলাদেশ—কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ও উদ্ভাবননির্ভর একটি রাষ্ট্র।

৬. জনসংখ্যাগত শক্তি

বাংলাদেশের ৬৫% মানুষ ৩৫ বছরের নিচে।

এই জনসম্পদ যদি যথাযথ শিক্ষা ও কর্মসংস্থানের মাধ্যমে কাজে লাগানো যায়, তবে আগামী ১৫–২০ বছরে বাংলাদেশ অভূতপূর্ব প্রবৃদ্ধি অর্জন করতে পারবে।

II. সরকার ও বৈদেশিক কূটনীতিঃ-বর্তমান নেতৃত্বের শক্তি

১. নেতৃত্বের সক্ষমতা ও ভবিষ্যৎ পরিকল্পনাঃ-

বর্তমান সরকার, নোবেল বিজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে, দেখিয়েছে:

রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ও দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনার ধারাবাহিকতা।

শতবর্ষের ডেল্টা প্ল্যান ২১০০-এর রূপায়ণ।

শিক্ষা, প্রযুক্তি ও অবকাঠামোতে ব্যাপক বিনিয়োগ।

আন্তর্জাতিক বাণিজ্য ও শক্তি চুক্তির মাধ্যমে বৈশ্বিক সম্পৃক্ততা।

যদিও রাজনৈতিক স্বাধীনতা নিয়ে কিছু সমালোচনা রয়েছে, এই সরকার প্রকল্প বাস্তবায়ন, অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনা ও মুদ্রানীতি স্থিতিশীলতায় উল্লেখযোগ্য দক্ষতা দেখিয়েছে।

২. বৈদেশিক সম্পর্ক ও কৌশলঃ-

বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতি ভারসাম্যপূর্ণ ও বহুমাত্রিক:

ভারত: ট্রানজিট, বাণিজ্য ও বিদ্যুৎ সহযোগিতা।

চীন: অবকাঠামো ও বিনিয়োগ (বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ)।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন: প্রধান রপ্তানি বাজার ও উন্নয়ন সহযোগী।

জাপান: মেট্রোরেল, মাতারবাড়ি ও শিল্প অঞ্চল উন্নয়নে অন্যতম অংশীদার।

মধ্যপ্রাচ্য: রেমিটেন্স ও জ্বালানি সহযোগিতার কেন্দ্র।

রাশিয়া: পারমাণবিক শক্তি ও বিদ্যুৎ খাতের অংশীদার।

বাংলাদেশের বৈদেশিক কূটনীতি বুদ্ধিদীপ্ত, ব্যবসায়কেন্দ্রিক ও অ-জোটভুক্ত, যা বৈশ্বিক প্রতিকূলতা থেকে দেশকে দূরে রাখতে সাহায্য করছে।

III. চ্যালেঞ্জসমূহঃ-কোন বাধাগুলো পথ আটকে দিতে পারে

১. রাজনৈতিক মেরুকরণ ও গণতন্ত্রের দুর্বলতা

গঠনমূলক বিরোধীদলীয় রাজনীতির অভাব।

মতপ্রকাশের স্বাধীনতা, নির্বাচন ও বিচার ব্যবস্থার বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন।

২. দুর্নীতি ও আমলাতান্ত্রিক জটিলতা

ব্যাংক, সরকারি ক্রয় এবং পরিষেবা খাতে দুর্নীতি ব্যাপক।

দীর্ঘসূত্রিতা বিদেশি বিনিয়োগকে নিরুৎসাহিত করে।

৩. দক্ষতা ঘাটতি ও শিক্ষার মান

উচ্চ ভর্তি হার থাকলেও মানসম্পন্ন শিক্ষা এখনো অনুপস্থিত।

দক্ষ জনবল না থাকায় আইসিটি, প্রকৌশল ও সেবা খাতে চাহিদা পূরণে সমস্যা হচ্ছে।

৪. পরিবেশ ও জলবায়ুজনিত ঝুঁকি

পৃথিবীর অন্যতম জলবায়ু-ঝুঁকিপূর্ণ দেশ।

ঘূর্ণিঝড়, বন্যা ও লবণাক্ততার কারণে কৃষি ও জীবন জীবিকা হুমকির মুখে।

IV. সমাধানঃ-উদীয়মান টাইগারে পরিণত হওয়ার রূপরেখা

১. রাজনৈতিক সংস্কার

অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন নিশ্চিত করা।

স্থানীয় সরকারকে শক্তিশালী করা।

গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রতি আস্থা পুনরুদ্ধার।

২. দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স

সব সরকারি সেবায় ডিজিটাল ব্যবস্থা বাধ্যতামূলক করা।

দুর্নীতি দমন কমিশনকে পূর্ণ স্বাধীনতা দেওয়া।

সরকারি কর্মকর্তাদের সম্পদ বিবরণী ও শাস্তির কার্যকর প্রয়োগ।

৩. মানবসম্পদে বিনিয়োগ

কারিগরি ও এসটিইএম-ভিত্তিক শিক্ষা ব্যবস্থার সংস্কার।

ইন্ডাস্ট্রি ও প্রাইভেট খাতের সঙ্গে প্রশিক্ষণ কার্যক্রম।

বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে উদ্ভাবনী গবেষণার কেন্দ্রে পরিণত করা।

৪. শিল্পায়ন ও বৈদেশিক বিনিয়োগ কৌশল

পোশাকের বাইরে আইটি, ওষুধ, কৃষি প্রক্রিয়াকরণ ও হালকা প্রকৌশল খাতে প্রসার।

“মেইড ইন বাংলাদেশ” কে আন্তর্জাতিক ব্র্যান্ডে রূপান্তর।

ব্যবসায়িক পরিবেশ সহজ করা ও আমলাতন্ত্র দূর করা।

৫. জলবায়ু অভিযোজন ও সবুজ প্রবৃদ্ধি

নবায়নযোগ্য জ্বালানি ও পরিবেশবান্ধব নগর উন্নয়ন।

জলবায়ু সহনশীল কৃষিতে বিনিয়োগ।

আন্তর্জাতিক জলবায়ু অর্থায়ন অর্জনের কৌশল গ্রহণ।

উপসংহারঃ-শিখরে পৌঁছানোর দ্বারপ্রান্তে বাংলাদেশ

আজকের বাংলাদেশ আর হতাশার নয়—এটি সাহসিকতা, আত্মবিশ্বাস এবং উচ্চাকাঙ্ক্ষার নাম। বাংলাদেশের অর্থনীতি দ্রুতগতির, জনগণ উদ্যমী, আর বৈশ্বিক দরজাগুলো উন্মুক্ত। যদি সুশাসন, সংস্কার ও উদ্ভাবনের পথ অব্যাহত থাকে, তাহলে বাংলাদেশকে বিশ্বের পরবর্তী এশিয়ান টাইগার হওয়া থেকে কেউ ঠেকাতে পারবে না।

ভবিষ্যৎ আর অপেক্ষা নয়-এটি এখন নির্মিত হচ্ছে, আমাদের হাতেই।

* বাংলাদেশের গর্জন এবার সারা এশিয়ায় শুনুক বিশ্ব। টাইগার আর ঘুমিয়ে নেই — সে এখন দৌড়াতে প্রস্তুত।

লেখক। কলাম লেখক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক