জুমার দিনে বান্দার দোয়া কবুলের বিশেষ বিশেষ সময়

Sanchoy Biswas
বাংলাবাজার ডেস্ক
প্রকাশিত: ১১:৫১ পূর্বাহ্ন, ২৫ এপ্রিল ২০২৫ | আপডেট: ৫:৪৮ অপরাহ্ন, ১৫ অগাস্ট ২০২৫
ছবিঃ সংগৃহীত
ছবিঃ সংগৃহীত

জুমার দিন অত্যন্ত মর্যাদাপূর্ণ ফজিলতের দিন। এ দিন দ্বারা আল্লাহতায়ালা ইসলামকে বিশেষ মর্যাদা প্রদান করেছেন এবং মুসলমানদের জন্য এই দিনটি আল্লাহ তায়ালার বিশেষ দান। আর দুআর মাধ্যমে বান্দার আবদিয়্যাত গুণের প্রকাশ ঘটে। দুআ হল আল্লাহর সামনে বান্দার সমর্পণ, বান্দার হীনতা ও দীনতার প্রকাশ, আল্লাহমুখিতা এবং আল্লাহ ও বান্দার মাঝে বিশেষ সম্পর্কের উত্তম বহিঃপ্রকাশ। আর এসব বিষয় হল ইবাদত ও আবদিয়্যাতের রূহ ও প্রাণ। তাই দুআ একটি গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত।

নুমান ইবনে বাশীর রা. বলেন, আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন-

আরও পড়ুন: নুসুক অ্যাপ এখন থেকে ইন্টারনেট ছাড়াই ব্যবহার করা যাবে

الدُّعَاءُ هُوَ الْعِبَادَةُ.

দুআই ইবাদত।

আরও পড়ুন: ঐতিহাসিক হোসেনি দালান থেকে তাজিয়া মিছিল শুরু

এরপর এর সমর্থনে তিনি এই আয়াত তিলাওয়াত করেছেন- 

وَقَالَ رَبُّكُمُ ادْعُوْنِیْۤ اَسْتَجِبْ لَكُمْ اِنَّ الَّذِیْنَ یَسْتَكْبِرُوْنَ عَنْ عِبَادَتِیْ سَیَدْخُلُوْنَ جَهَنَّمَ دٰخِرِیْنَ.

তোমাদের প্রতিপালক বলেছেন, আমাকে ডাক। আমি তোমাদের ডাকে সাড়া দেব। নিশ্চয়ই অহংকারবশে যারা আমার ইবাদত থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়, তারা লাঞ্ছিত হয়ে জাহান্নামে প্রবেশ করবে। [সূরা মুমিন (৪০) : ৬০] -জামে তিরমিযী, হাদীস ২৯৬৯; সুনানে আবু দাউদ, হাদীস ১৪৭৯; সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদীস ৩৮২৮

জাবের ইবনে আবদুল্লাহ রা. বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন-

يَوْمُ الْجُمُعَةِ اثْنَتَا عَشْرَةَ سَاعَةً، وَلَا يُوجَدُ عَبْدٌ مُسْلِمٌ يَسْأَلُ اللهَ شَيْئًا إِلّا آتَاهُ اللهُ، فَالْتَمِسُوهَا آخِرَ السّاعَةِ بَعْدَ الْعَصْرِ.

জুমার দিন বারো ভাগ। (এর মধ্যে একটি সময় আছে, যাতে) কোনো মুসলিম বান্দা আল্লাহ তাআলার কাছে যা প্রার্থনা করবে আল্লাহ তাআলা নিশ্চয় তা দান করবেন। সে সময়টি তোমরা অনুসন্ধান কর আসরের পর দিনের শেষ অংশটিতে। -মুস্তাদরাকে হাকেম, হাদীস ১০৩২; সুনানে আবু দাউদ, হাদীস ১০৪৮; সুনানে নাসায়ী, হাদীস ১৩৮৯১

সেই মুহূর্ত কোনটি?

হাদীস থেকে জানা যায়, জুমার দিন একটি সময় বান্দার দুআ অবশ্যই কবুল হয়। সেই ফযীলতপূর্ণ সময়টা কখন? জুমার দিনের যে সময়টিতে দুআ কবুলের নিশ্চয়তা দেওয়া হয়েছে সেটা কোন্ সময়? এ সম্পর্কে সাহাবা, তাবেঈন ও পরবর্তী উলামায়ে কেরামের একাধিক বক্তব্য পাওয়া যায়।

হাফেয ইবনে হাজার রাহ. লেখেন-

وَلَا شَكّ أَنّ أَرْجَحَ الْأَقْوَالِ الْمَذْكُورَةِ حَدِيثُ أَبِي مُوسَى وَحَدِيثُ عَبْدِ اللهِ بْنِ سَلَامٍ.

এতে কোনো সন্দেহ নেই যে, এসব মতের মধ্যে সবচেয়ে অগ্রগণ্য মত হল- আবু মূসা আশআরী রা. ও আবদুল্লাহ ইবনে সালাম রা.-এর হাদীসে উল্লেখিত দুটি মত। -ফাতহুল বারী ২/৪৮৮

ইবনে হাজার আসকালানী রাহ.-এর বক্তব্য থেকে জানা গেল, জুমার দিনের সেই বিশেষ সময়টি সম্পর্কে যত মত আছে এর মধ্যে অগ্রগণ্য হল দুটি :

এক. যে সময়ের কথা পাওয়া যায় আবু মূসা আশআরী রা.-এর হাদীসে। সেই হাদীসে এসেছে, জুমার দিনের দুআ কবুলের সময় হল, খতীব (খুতবার জন্য) মিম্বরে বসার পর থেকে নামায শেষ করা পর্যন্ত।

আবু বুরদা রাহ. বলেন, আবদুল্লাহ ইবনে উমর রা. আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, জুমার দিনের দুআ কবুলের সময় সম্পর্কে আপনার পিতা আবু মূসা আশআরী রা.-এর কাছ থেকে কোনো হাদীস শুনেছেন?

আমি বললাম, হাঁ, শুনেছি। তাঁকে বলতে শুনেছি, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন-

هِيَ مَا بَيْنَ أَنْ يَجْلِسَ الْإِمَامُ إِلَى أَنْ تُقْضَى الصّلَاةُ.

সে সময়টি হল, খতীব (খুতবার জন্য মিম্বরে) বসার পর থেকে জুমার নামায শেষ করা পর্যন্ত। -সহীহ মুসলিম, হাদীস ৮৫৩; সুনানে আবু দাউদ, হাদীস ১০৪৯; সহীহ ইবনে খুযায়মা, হাদীস ১৭৩৯

দুই. যে সময়ের কথা পাওয়া যায় আবদুল্লাহ ইবনে সালাম রা.-এর হাদীসে। সেখানে এসেছে,  দুআ কবুলের বিশেষ সময়টি হল, আসরের পর সূর্য অস্তমিত হওয়া পর্যন্ত।

আবু সালামা রাহ. বলেন, আমি  আবদুল্লাহ ইবনে সালাম রা.-কে প্রশ্ন করলাম-

أَيّةُ سَاعَةٍ هِيَ؟

ঐ সময়টা কোনটা?

তিনি বলেছেন-

آخِرُ سَاعَاتِ النّهَارِ.

তা হল, দিনের শেষ ভাগ। -মুসনাদে আহমাদ, হাদীস ২৩৭৮১; সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদীস ১১৩৯

আরেক হাদীসে এসেছে, আবু হুরায়রা রা. একবার কা‘ব আহবার রাহ.-কে কয়েকটি হাদীস শুনিয়েছেন। একটি হল, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন-

وَفِيهِ سَاعَةٌ لاَ يُصَادِفُهَا عَبْدٌ مُسْلِمٌ وَهُوَ يُصَلِّي، يَسْأَلُ اللهَ شَيْئًا، إِلاّ أَعْطَاهُ إِيّاهُ.

জুমার দিন একটি সময় আছে, কোনো মুসলিম নামাযরত অবস্থায় তখন আল্লাহর নিকট যা চাইবে আল্লাহ অবশ্যই তা দান করবেন।

কা‘ব আহবার রাহ. বললেন-

ذَلِكَ فِي كُلِّ سَنَةٍ يَوْمٌ.

এই দিনটি প্রতি বছর এক দিন।

আবু হুরায়রা রা. বলেন, আমি বললাম-

بَلْ فِي كُلِّ جُمُعَةٍ.

না, বরং প্রত্যেক জুমার দিন।

তখন তিনি তাওরাত খুলেছেন এবং তা দেখার পর বলেছেন-

صَدَقَ رَسُولُ اللهِ صَلى الله عَلَيهِ وَسَلمَ.

হাঁ, আল্লাহর রাসূল সত্য বলেছেন।

আবু হুরায়রা রা. বলেন, এরপর একদিন আবদুল্লাহ ইবনে সালাম রা.-এর সাথে সাক্ষাৎ করি। তাকে কা‘ব আহবারের সাথে সাক্ষাতের বিষয় এবং তাকে যে হাদীস শুনিয়েছি এর বিবরণ দিই। তখন আবদুল্লাহ ইবনে সালাম রা. বললেন-

قَدْ عَلِمْتُ أَيّةَ سَاعَةٍ هِيَ.

সে সময়টা কখন, তা আমি জানি।

আবু হুরায়রা রা. বলেন, আমি বললাম, আমাকে বলুন, আমার সাথে কৃপণতা করবেন না।

আবদুল্লাহ ইবনে সালাম রা. বললেন-

هِيَ آخِرُ سَاعَةٍ فِي يَوْمِ الْجُمُعَةِ.

সময়টি হল, জুমার দিনের শেষ সময়।

আবু হুরায়রা রা বলেন, আমি বললাম, ঐ সময় কীভাবে হবে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, মুসলিম বান্দা ঐ সময় নামাযরত থাকবে! আর আছরের পর তো নামায পড়া যায় না?

আবদুল্লাহ ইবনে সালাম রা. উত্তর দিয়েছেন-

أَلَمْ يَقُلْ رَسُولُ اللهِ صَلى الله عَلَيهِ وَسَلمَ: مَنْ جَلَسَ مَجْلِسًا يَنْتَظِرُ الصّلاَةَ فَهُوَ فِي صَلاَةٍ حَتّى يُصَلِّيَ؟

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কি বলেননি, কোনো ব্যক্তি যতক্ষণ পর্যন্ত নামাযের অপেক্ষায় বসে থাকবে, ততক্ষণ  সে নামাযে আছে?

আবু হুরায়রা রা. বলেন, আমি বললাম, হাঁ।

আবদুল্লাহ ইবনে সালাম রা. বললেন-

فَهُوَ ذَلِكَ.

হাদীসে (নামাযরত বলার দ্বারা) এটাই উদ্দেশ্য। -মুয়াত্তা মালেক, হাদীস ২৯১; মুসনাদে আহমাদ, হাদীস ২৩৭৮৫; সুনানে আবু দাউদ, হাদীস ১০৪৬; জামে তিরমিযী, হাদীস ৪৯১

অর্থাৎ দুআ কবুলের হাদীসটিতে যে বলা হয়েছে, নামাযরত অবস্থায় দুআ করবে, এর দ্বারা উদ্দেশ্য হল, দিনের শেষ সময়ে বসে মাগরিবের নামাযের অপেক্ষায় থাকবে এবং দুআ করতে থাকবে। আর যে ব্যক্তি নামাযের অপেক্ষায় থাকে সে নামাযেই থাকে। 

যাইহোক আবদুল্লাহ ইবনে সালাম রা. বলেছেন, হাদীস শরীফে জুমার দিনের যে সময় দুআ কবুলের প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছে সে সময়টি হল, দিনটির শেষ অংশ। এই কথা নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে বর্ণিত অন্যান্য হাদীসেও উল্লেখ হয়েছে।  যেমন ইতিপূর্বে জাবের ইবনে আবদুল্লাহ রা.-এর হাদীসে  এসেছে, আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন-

فَالْتَمِسُوهَا آخِرَ السّاعَةِ بَعْدَ الْعَصْرِ.

সে সময়টি তোমরা অনুসন্ধান কর আসরের পর দিনের শেষ অংশটিতে।

মোটকথা জুমার দিনের দুআ কবুলের সময় কোন্টি, তা নির্ধারণ নিয়ে যদিও বহু মত রয়েছে, তবে এসবের মধ্যে অগ্রগণ্য মত হল দুইটি :

এক.

খতীব খুতবা দেওয়ার জন্য মিম্বরে উঠার পর থেকে নামায শেষ করা পর্যন্ত। আবু মূসা আশআরী রা., আবদুল্লাহ ইবনে উমর রা., আবু বুরদা রাহ. প্রমুখ এই মতের প্রবক্তা। (দ্রষ্টব্য : মুসান্নাফে ইবনে আবী শায়বা, বর্ণনা ৫৫০৬, ৫৫০৭; আততামহীদ, ইবনে আবদুল বার ১৯/২২

দুই.

জুমার দিনের শেষ সময় তথা আসরের নামাযের পর থেকে সূর্য অস্ত যাওয়া পর্যন্ত। আবদুল্লাহ ইবনে সালাম রা., আবু হুরায়রা রা., আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা., কা‘ব আহবার রাহ., সাঈদ ইবনে জুবায়ের রাহ., মুজাহিদ রাহ. ও তাউস রাহ. প্রমুখ এই মত গ্রহণ করেছেন। (দ্রষ্টব্য : মুসান্নাফে  ইবনে আবী শায়বা, বর্ণনা ৫৫০৩-৫৫০৫, ৫৫১৪; আততামহীদ ১৯/২০, ২৩-২৪; আলইস্তিযকার ৫/৮২, ৮৬, ৯৭)

সুতরাং আমরা জুমার দিন এই দুই সময় দুআর এহতেমাম করব। তাহলে ইনশাআল্লাহ আমাদের ঐ বিশেষ সময়ের ফযীলত লাভ হবে এবং আমাদের দুআ আল্লাহ কবুল করবেন। ইমাম আবু উমর ইবনে আবদুল বার রাহ. বলেছেন-

والذي ينبغي لكل مسلم الاجتهادُ في الدعاء للدين والدنيا في الوقتين المذكورين رجاءَ الإجابة، فإنه لا يخيب إن شاء الله.

প্রত্যেক মুসলিমের উচিত, কবুলের আশা নিয়ে তার দ্বীন-দুনিয়ার যাবতীয় বিষয়ের জন্য এই দুই সময়ে গুরুত্বের সাথে দুআ করা। তাহলে ইনশাআল্লাহ, তার দুআ বৃথা যাবে না। -আততামহীদ ১৯/২৪