সাতক্ষীরায় পাউবো'র স্লুইসগেট নির্মাণে পাহাড়সম দুর্নীতি

সাতক্ষীরার পানি উন্নয়ন বোর্ডের বিনেরপোতা কুলতিয়া খালে স্লুইসগেট নির্মাণ কাজে পাহাড়সম অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগে নির্বাহী প্রকৌশলী আশিকুর রহমান কে সাময়িক বরখাস্ত করেছে কর্তৃপক্ষ। ইতোপূর্বে একই অভিযোগে পাউবোর প্রধান কার্যালয় থেকে উপবিভাগীয় প্রকৌশলী (এসডিই) জাকারিয়া ফেরদৌস ও উপসহকারী প্রকৌশলী অনি দাসকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়।
তদন্ত প্রতিবেদনে প্রকল্পের পিডি পাউবোর খুলনার তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী সবিবুর রহমান ও নির্বাহী প্রকৌশলী আশিকুর রহমানসহ কয়েকজন কর্মকর্তা ২৭ দিন কাজের বাস্তব অবস্থা না দেখে শিট পাইলের বিল পরিশোধ করার প্রমাণও মিলেছে। ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান মেসার্স আমিন অ্যান্ড কোং-এর স্বত্বাধিকারী রুহুল আমিনের অনুকূলে।
আরও পড়ুন: সাদা পাথর রক্ষায় প্রশাসনের ৫ দফা সিদ্ধান্ত
উল্লেখ্য, উক্ত কাছে দুর্নীতির অভিযোগে পাউবো খুলনার প্রধান প্রকৌশলী বিদ্যুৎ কুমার সাহা ১৩ মে প্রকল্পের পিডি সবিবুর রহমান ও নির্বাহী প্রকৌশলী আশিকুর রহমানকে নিয়ে সরজমিনে সাইট পরিদর্শনে এসে ঘটনার সত্যতা পান।
একই অভিযোগের ভিত্তিতে ১৪মে দুদকের খুলনা সমন্বিত জেলা কার্যালয়ের একটি এনফোর্সমেন্ট টিম সরজমিনে অভিযান পরিচালনা করে প্রকল্প এলাকায়।এ সময় প্রকল্প সংশ্লিষ্ট রেকর্ডপত্র পর্যালোচনা ও সরেজমিন পর্যবেক্ষণে ওই প্রকল্পে ১৪০টি শিট পাইল স্থাপন করার তথ্য পাওয়া যায়। স্লুইচ গেটের স্থায়িত্ব ধরে রাখার জন্য মাটির নিচে ৬ মিটার শীট পাইলিং করার কথা।
আরও পড়ুন: পাবনায় অনির্দিষ্টকালের জন্য ডাকা পরিবহণ ধর্মঘট প্রত্যাহার
অভিযানে দুদক বাস্তব সত্যতা প্রমাণের জন্য এলজিইডি’র দুজন অভিজ্ঞ প্রকৌশলীকে আউটসোর্সিং করে ঘটনাস্থলে নিয়ে ১৪০ টি সিট পাইলিং এর মধ্যে দ্বৈবচয়নের ভিত্তিতে দুটি শিট পাইলিংয়ের মাটি খুড়তেই বেরিয়ে আসে ভয়ংকর লোপাটের চিত্র। উত্তোলন কালে ৬ মিটার পাইলিংয়ের স্থলে পাওয়া যায় ৩ মিটার সিট পাইলিং।যার অর্ধেকটাই চুরি।এছাড়া দুদক তার আইনবলে পৃথক মামলাও করে। এই ঘটনার পরপরই নড়েচড়ে বসে পাউবো কতৃপক্ষ।
ঘটনাস্থল থেকে ফিরে দুদক এ বিষয়ে বিস্তারিত প্রতিবেদন প্রস্তুত করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে পানি উন্নয়ন বোর্ডের মহাপরিচালককে চিঠি দেন। সরজমিনে যেয়ে দেখা গেছে দুদকের অভিযানের পর সেখানে সম্পূর্ণ কাজ বন্ধ রয়েছে
তথ্যানুসন্ধানে জানা গেছে, বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলায় সরকার পাউবোর মাধ্যমে ৪৭৫ কোটি টাকার প্রকল্প হাতে নেয়। এই প্রকল্পের ডিপিপিতে ৭৮টি প্যাকেজের উল্লেখ রয়েছে। এর মধ্যে ৭৪টি প্যাকেজের দরপত্র আহ্বান করা হলেও কার্যাদেশ দেওয়া হয়েছে ৭৩টি প্যাকেজ বাস্তবায়নে। ব্যয়বহুল এই কাজের মধ্যে নতুন রেগুলেটর নির্মাণ রয়েছে ৬টি। আরও ৪টি প্যাকেজে ২১টি রেগুলেটর মেরামতের কাজও আছে। এ ছাড়া মারিচ্চাপ নদী ও বেতনা নদীর প্রবাহ ঠিক রাখার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে বিভিন্ন প্যাকেজে। এর মধ্যে মারিচ্চাপ নদীতে ৩৭ কিলোমিটার খননের কাজ রাখা হয়েছে এক্সকেভেটরের মাধ্যমে। আর বেতনা নদী ড্রেজারের মাধ্যমে ড্রেজিংয়ের কাজ আছে ৪৪ কিলোমিটার। এছাড়া বেতনা নদীর সাড়ে ২৩ কিলোমিটার কাটা হবে এক্সকেভেটর দিয়ে। ১১৩ কিলোমিটার বাঁধ মেরামত ও পৌনে ২ কিলোমিটার বাঁধের প্রতিরক্ষা কাজও আছে ৪টি প্যাকেজে। এর মধ্যে সাতক্ষীরার বিনেরপোতা কুলুতিয়া খালে একটি স্লুইসগেট নির্মাণে চরম অনিয়ম ও দুর্নীতির প্রমাণ পাওয়া যায় ।
উক্ত ঘটনার পর বিভাগীয় তদন্ত কমিটির প্রধান অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী (রিভার ম্যানেজমেন্ট) মো:মাহফুজুর রহমান গত ৪ জুন পাউবোর মহাপরিচালকের কাছে ১৪ পৃষ্ঠার তদন্ত প্রতিবেদন জমা দিয়েছেন। প্রতিবেদন অনুযায়ী সাতক্ষীরার পাউবোর নির্বাহী প্রকৌশলী আশিকুর রহমানকে বুধবার রাতে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে।
তদন্ত প্রতিবেদনে, নির্বাহী প্রকৌশলী আশিকুর রহমানের দেওয়া তথ্য উল্লেখ করে বলা হয়, ১৮ থেকে ৩০ এপ্রিলের মধ্যে ৬ মিটার দৈর্ঘ্যরে শিট পাইল কেটে ৩ মিটার দৈর্ঘ্যে ভাগ করা হয়। ৬ মিটার দৈর্ঘ্যের ১৪০টি শিট পাইল ঠিকাদার প্রতিনিধির কাছে বুঝিয়ে দেওয়া হয়।
আর শাখা কর্মকর্তা (এসও) অনি দাসের বক্তব্য অনুযায়ী তার অনুপস্থিতিতে ২ থেকে ২৯ এপ্রিল পর্যন্ত ২৭ দিনের মধ্যে সাইটে শিট পাইল কাটা, রং করা, শিট পাইল ড্রাইভ এবং শিট পাইলের ক্যাপ ঢালাই হয়। এই ২ থেকে ২৯ এপ্রিল তারিখের মধ্যে শাখা কর্মকর্তা ও উপবিভাগীয় প্রকৌশলীর পরিদর্শন বিষয়ে কোনো তথ্য নিশ্চিত করতে পারেনি তদন্ত কমিটি।
এই ২৭ দিন কাজের খোঁজখবর রাখলেও ৮ এপ্রিল ফিল্ড মেজারমেন্টের পরিপ্রেক্ষিতে শিট পাইল সরবরাহের বিল প্রদান করা হয়। ওই কাজের পরিমাপ বইয়ে নির্বাহী প্রকৌশলী আসিকুর রহমান, উপবিভাগীয় প্রকৌশলী মো. জাকারিয়া ফেরদৌস, এসও অনি দাসের স্বাক্ষর রয়েছে। অথচ ৮ এপ্রিল এসব কর্মকর্তার সাইট পরিদর্শনের কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি। দীর্ঘ সময় সাইট পরিদর্শন না করায় এমন পরিস্থিতি উদ্ভবের সুযোগ হয়েছে মর্মে কমিটির কাছে প্রতীয়মান হয়। তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়, খুলনার তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী ও প্রকল্পের পিডির দাখিলকৃত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ‘কাজের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের বিশেষ করে শাখা কর্মকর্তা ও উপবিভাগীয় প্রকৌশলীর অনুপস্থিতিতে ১৪০টি শিট পাইল বসানো হয়েছে এসও ও এসডি কিছুই জানতে পারেননি বিষয়টি বাস্তবসম্মত নয়। পিডির এই বক্তব্যের সঙ্গে কমিটি সহমত পোষণ করেন। আর সাইট অর্ডার বুক অনুযায়ী কাজ শুরুর পর সংশ্লিষ্ট নির্বাহী প্রকৌশলী আশিকুর রহমান ১৬ মার্চ উক্ত সাইট পরিদর্শন করেন। রেগুলেটরের মতো গুরুত্বপূর্ণ কাজে যতটুকু গুরুত্ব দেওয়া প্রয়োজন ছিল, নির্বাহী প্রকৌশলী তা দিতে পারেননি।
২৪ থেকে ৩০ এপ্রিলের মধ্যে স্লুইসগেটের কাজে স্পেসিফিকেশনবহির্ভূত শিট পাইল দেওয়ার তথ্য জানার পরও ঊর্ধ্বতন কোনো কর্মকর্তাকে বিষয়টি অবহিত করেননি।
স্পেসিফিকেশন অনুযায়ী কাজ না হওয়ার খবর পেয়ে খুলনার অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী কাজটি যে অবস্থায় আছে সে অবস্থায় রাখার নির্দেশনা দেন। এরপরও সাইটটিকে বিভাগীয় নিয়ন্ত্রণে আনা হয়নি। ফলে নির্বাহী প্রকৌশলী দায় এড়াতে পারেন না। এমনকি সাইট অর্ডার বুক অথবা অন্য কোনো ডকুমেন্ট থেকে ১৩ মে’র আগে প্রকল্প পরিচালক মো. সবিবুর রহমান আলোচ্য সাইট পরিদর্শন করেছেন এমন রেকর্ডও পাওয়া যায়নি।