‘চাপে’র বাজারে চাহিদা বেশি ছোট গরুর

দরজায় কড়া নাড়ছে মুসলমানদের অন্যতম ধর্মীয় উৎসব ঈদুল আজহা। এ ঈদে কোরবানি দিতে পছন্দের পশু কিনছেন তারা। তবে অন্যান্য বছর কোরবানির ঈদে মাঝারি গরুর চাহিদা থাকলেও এবার ছোট গরুর চাহিদা বেশি। এমনকি ভাগে কোরবানি দেন, এমন মানুষজনও খোঁজ করছেন ছোট গরুর। কারণ একটাই, গরুর দাম বেশি।
ক্রেতাদের ভাষ্য, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির কারণে এবার বড় গরু, উট ও দুম্বার দিকে মানুষের তেমন ঝোঁক নেই। প্রতি বছর গাবতলী হাটে উট পাওয়া গেলেও গতকাল সোমবার উটের দেখা মেলেনি এ হাটে। বিক্রেতারাও চেষ্টা করেছেন ক্রেতাদের চাহিদা অনুযায়ী ছোট গরু বাজারে আনার। রাজধানীর বছিলা হাটে ছোট গরু তুলনামূলকভাবে বেশি পাওয়া যাচ্ছে।
আরও পড়ুন: প্রথম ১০ দিনে অনলাইনে ই-রিটার্ন দাখিল করলেন ৯৬ হাজারের বেশি করদাতা
বিক্রেতারা জানিয়েছেন, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি, বিশেষত গো-খাদ্যের দাম বেড়ে যাওয়ায় পশু পালনের খরচ বেড়েছে। তাই কৃষকদের কাছ থেকে গরু কিনতে হয়েছে আগের চেয়ে বেশি দাম দিয়ে। সংগতকারণেই বেশি দামে বিক্রি করা ছাড়া তাদের কোনো উপায় নেই।
রাজধানীর গাবতলী ও সারুলিয়া ছাড়াও ১৮টি স্থানে অস্থায়ী হাটে গরু, ছাগল, ভেড়া ও দুম্বাসহ কোরবানি পশু বেচাকেনা চলছে। তা ছাড়া নগরীর অলিগলি ও ফাঁকা জায়গায় অবৈধ অনেক হাট বসে যাচ্ছে। স্থানীয় ক্ষমতাসীন দলের প্রভাবশালী নেতাকর্মী ও কাউন্সিলরদের অনুসারীরা এসব হাট বসাচ্ছেন বলে অভিযোগ উঠেছে।
আরও পড়ুন: পাম অয়েলের দাম লিটারে কমলো ১৯ টাকা
সোমবার দেখা গেছে, ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের কাওলা শিয়ালডাঙ্গা অস্থায়ী পশুর হাটটি কোরবানির পশুতে কানায় কানায় পূর্ণ। ক্রেতা-বিক্রেতারা দরকষাকষিতে ব্যস্ত সময় পার করছেন। এ হাটে ছোট-বড় ও মাঝারি আকারের প্রচুর গরু উঠেছে। অন্যান্য হাটের তুলনায় বিক্রিও বেশি।
ইজারাদার প্রতিনিধি শামীম আহমেদ জানালেন, এখানে প্রচুর স্থানীয় লোক রয়েছে। তাদের বাড়িতে গরু রাখারও জায়গা রয়েছে। তাই অনেকেই আগেভাগে কোরবানির পশু কিনে ফেলেছেন। গত দুই দিন এ হাটে ৭শ থেকে ৮শ পশু বেচাকেনা হয়েছে। আজ রাতের মধ্যে সব পশু বিক্রি হয়ে যাবে বলে আশা প্রকাশ করেন তিনি।
‘ঠিকঠাক দাম না পেলে পথে বসতে হবে’
১৩টা ষাঁড় গরু নিয়ে কাওলার শিয়ালডাঙ্গা হাটে এসেছেন ঝিনাইদাহের আলী আজগর। তিনি জানান, গত বছর যে গরু এখানে দেড় লাখ টাকায় বিক্রি করেছি, সেই গরু এবার এলাকা থেকেই ২ লাখ টাকায় কিনতে হয়েছে। এরপর ট্রাক ভাড়াসহ আনুষঙ্গিক খরচ তো আছেই। গরুর কাছে থাকা একটা বস্তা থেকে ভুসি বের করে তিনি বলেন, ‘এই ভুসি গত বছর কিনেছি ৪৫ টাকায়। এবার প্রতি কেজির দাম ৬০ টাকা। অথচ মানুষ এসে গত বছরের মতো দাম বলছে। ঠিকঠাক দাম না পেলে পথে বসতে হবে।’
একই হাটের বেপারি কুষ্টিয়ার রফিকুল ইসলাম বলেন, গতবার যে ভুসির বস্তা ২ হাজার টাকায় কিনেছি, সেটার দাম এবার ৩৫০০ টাকা। ৬০০ টাকার মাংস হয়েছে ৭০০ টাকা। আমাদের খরচ কম হলে কম দামে বিক্রি করতে কোনো সমস্যা ছিল না। কিন্তু এসব বিষয় সবাই বুঝতে পারছে না।’
তেজগাঁও হাটে কথা হয় নাটোরের জালাল হোসেনের সঙ্গে। তিনি জানান, ‘আমাদের গরু কেনা পড়েছে ৩০ থেকে ৩২ হাজার টাকা মণ। সেখানে খরচসহ কিছু লাভ যুক্ত করে ৩৫ থেকে ৩৬ হাজার টাকায় বিক্রির ইচ্ছা আছে। তা না করতে পারলে সব পরিশ্রমই ব্যর্থ হবে।’ একই কথা জানালেন সিরাজগঞ্জের টিপু সুলতানও।
উট নেই গাবতলী হাটে
প্রতি বছর উট পাওয়া গেলেও ঢাকার ঐতিহ্যবাহী গাবতলী হাটে এবার উট ওঠেনি। তবে প্রতিবারের মতো এবারও গাবতলী স্থায়ী পশুর হাটে পাওয়া যাচ্ছে অ্যারাবিয়ান দুম্বা। দেড় লাখ টাকা থেকে শুরু করে সাড়ে ৫ লাখ টাকার মধ্যে এসব দুম্বা বিক্রি হচ্ছে। মো. শিপলু নামের এক বেপারি জানান, বিভিন্ন জাতের ২০টি দুম্বা হাটে তুলেছিলেন তিনি। এর মধ্যে ১৭ টি দুম্বা বিক্রি হয়ে গেছে। সর্বনিম্ন দেড় লাখ টাকায় দুম্বা বিক্রি করেছেন তিনি। সর্বোচ্চ আড়াই লাখ টাকায় বিক্রি হয়েছে তার দুম্বা। আমজাদ নামের অপর বেপারি জানান, তার কাছে সর্বনিম্ন যে দুম্বা রয়েছে, তার দাম আড়াই লাখ টাকা। আর সর্বোচ্চ দুম্বার দাম সাড়ে ৫ লাখ টাকা। তবে দরদাম করে কেনার সুযোগ আছে।
এদিকে, ক্রেতাদের সমাগম দেখা গেলেও দামে বনিবনা না হওয়ায় গাবতলী হাট থেকে ফিরে যাচ্ছেন অনেকেই। শেষ মুহূর্তে পশুর দাম কমতে পারে এমন আশায়ও অপেক্ষা করছেন কেউ কেউ। তবে আজকের মধ্যে ক্রেতা না পেলে দাম পড়ে যাওয়ার আশঙ্কা করছেন বিক্রেতারা।
গতকাল সোমবার গাবতলী পশুর হাটে গিয়ে দেখা যায়, ট্রাকে করে শত শত গরু দেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে নিয়ে এসেছেন বেপারিরা। ক্রেতা সমাগমও কম নয়। তবে কয়েকজন ক্রেতার সঙ্গে কথা বলে দেখা গেল, গতবারের থেকে এবার পশুর দাম বেশি। তাদের দাবি, মাংসের দাম বেড়ে যাওয়ায় এবার গরুর দামও বাড়িয়ে দিয়েছেন গরু বেপারিরা। শেষ মুহূর্তে গরুর দাম কমার আশায় আছেন অধিকাংশ ক্রেতা।
মিরপুর থেকে ভাইয়ের সঙ্গে গরু কিনতে এসেছেন এনায়েত। তিনি বলেন, ‘কয়েকটা হাট ঘুরেছি। সব জায়গায় দাম একই মনে হয়েছে। গতবারের থেকে এবার পশুর দাম কিছুটা বেশি। শেষের দিকেই দাম কিছুটা কমতে পারে। তবে বাজেটের মধ্যে পেলে আমরা নিয়ে নেব।’
সোমবার সকালে মুন্সীগঞ্জ থেকে গাবতলী পশুর হাটে আটটি ষাঁড় গরু নিয়ে এসেছেন কামরুল বেপারি। এর মধ্যে একটি গরু ১ লাখ ৩০ হাজার টাকায় বিক্রি করেছেন তিনি। চাহিদামতো দাম না পাওয়ায় অন্য গরুগুলো এখনও বিক্রি করতে পারেননি। কামরুল বেপারি বললেন, ‘হাটে কাস্টমার নাই। কাস্টমার না এলে কীভাবে বিক্রি করব? যারা আসছেন তারা গরুর দাম জিজ্ঞেস করে চলে যাচ্ছেন। বাজার দেখে মনে হচ্ছে শেষের দিকে দাম কমতেও পারে। কালকের মধ্যে গরু না বেচতে পারলে লোকসানে ছাড়তে হবে পশু।’
আফতাবনগর, ধোলাইখাল, মেরাদিয়া, মিরপুর, উত্তরা দিয়াবাড়ি, বছিলা, কমলাপুর ও আমুলিয়া হাটেও পশু বেচাকেনার প্রায় একই চিত্র দেখা গেছে। এলাকাভিত্তিক এসব হাটেও শেষ দিনের অপেক্ষায় আছেন সবাই।
অবৈধ অর্ধশতাধিক হাট
সিটি করপোরেশনের অনুমোদিত অস্থায়ী হাট ছাড়াও ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় অবৈধ হাট বসাচ্ছেন স্থানীয় প্রভাবশালীরা। এসব হাটে কোরবানির পশু বেচাকেনা হলেও কোনো ‘হাসিল’ প্রয়োজন হয় না।
গত রবিবার ও সোমবার ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় এমন অর্ধশতাধিক হাটের সন্ধান মিলেছে। যার পেছনে ক্ষমতাসীন দলের প্রভাবশালী নেতাকর্মী ও ওয়ার্ড কাউন্সিলরের অনুসারীরা রয়েছেন।
এতে একদিকে সরকার যেমন রাজস্ব থেকে বঞ্চিত হচ্ছে, অন্যদিকে আবাসিক এলাকা ও সড়কের ওপর পশু বেচাকেনায় পরিবেশ নষ্ট হচ্ছে। বৈধ হাটগুলোতে ইজারার শর্তের কারণে বর্জ্য অপসারণসহ নানা সুযোগ-সুবিধা থাকলেও অবৈধ হাটগুলোতে তা নেই। প্রভাবশালীদের ছত্রছায়ায় এসব হাট বসায় বিরক্ত ও ক্ষুব্ধ হলেও কেউ কোনো কথা বলতে পারছেন না। সিটি করপোরেশনও এসব যেন দেখেও না দেখার ভান করছে।
রাজধানীর বাংলামোটর ও হাতিরঝিল ঘিরে চার থেকে পাঁচটি অবৈধ পশুর হাট বসেছে। রোববার রাতে দেখা যায়, বাংলামোটর এলাকার হাতিরঝিল সংলগ্ন পার্টেক্স গলির মুখে বসেছে অবৈধ ছাগলের হাট। কিছুদূর সামনে গিয়ে গলির ভিতরে ও ঢাকা মহানগর উত্তর ৩৫ নং ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সাহিদুর রহমান সাহিদের বাসার নিচে দুটি হাট বসিয়েছেন তিনি। এখানে দুটি হাটে ৫০টির বেশি গরু আছে। বাংলামোটর ইস্কাটন জামে মসজিদের পাশের গলিতে আরেকটি হাট বসিয়েছেন সাহিদের ভাতিজা ফজলু মিয়া। সেখানেও আশপাশের এলাকার ক্রেতারা এসে ভিড় করে গরু কিনছেন।
ক্রেতা সেজে দাম জিজ্ঞেস করলে ৩৫ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সাবেক সভাপতি সাহিদুর রহমান সাহিদ এ প্রতিবেদককে জানান, ‘সাড়ে তিন মণ থেকে পাঁচ মণ ওজনের গরু আছে এখানে। গরু কিনলে হাসিলের কোনো ঝামেলা নেই। তা ছাড়া এখানে ঈদের আগের দিন পর্যন্ত গরু রাখা যাবে।’
পাশেই হাতিরপুলের বিভিন্ন অ্যাপার্টমেন্টের নিচে বসেছে গরুর হাট। এসব হাট নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে প্রচারও চলছে। হাতিরপুলের অ্যাপার্টমেন্টের নিচে গরু বিক্রেতা ফয়েজ আহমেদ জানান, ‘গ্রামের বাড়ি নীলফামারী থেকে গরু এনে এখানে বিক্রি করছি। আশপাশের অ্যাপার্টমেন্টের মালিকরাই গরু কিনছে। এ ছাড়া ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিতরেও আমাদের গরু রাখা আছে। সেখানে শিক্ষক ও কর্মকর্তারা এসব গরু কিনছেন।’
তা ছাড়া হাতিরপুল বাজারে বসেছে অবৈধ গরু-ছাগলের হাট। রবিবার রাতে এ বাজারে মাংসের দোকানের সামনে ৫টি গরু বেঁধে রাখতে দেখা গেছে। সড়ক বিভাজকে আরও ১০-১২টি মাঝারি সাইজের গরু বেঁধে রেখেছেন তারা। পাশে বেশ কিছু ছাগলও আছে। সড়ক বিভাজকে গরুর খাবার খড়, ভুসি ইত্যাদি বিক্রি হচ্ছে।
ক্রেতা সেজে আলাপকালে ব্যবসায়ীরা জানান, বড় গরুগুলো তারা এনেছেন বিক্রির জন্য। ছোটগুলো জবাই করবেন। তবে কেউ কিনতে চাইলে রেখে দিবেন। এক প্রশ্নের জবাবে এক বিক্রেতা জানান, ‘এখান থেকে রহমতগঞ্জ হাট অনেক দূরে। স্থানীয় অনেক বাসিন্দা হাটে যাওয়ার সময় পান না। তাই বাসিন্দাদের সুবিধার্থে কিছু গরু নিয়ে আসা হয়।’
তা ছাড়া কচুক্ষেত প্রধান সড়কের ওপর, উত্তরা ৯ নম্বর সেক্টরের ৬ নম্বর রোডের কাঁচাবাজারের কাছে, যাত্রাবাড়ী কাঁচাবাজার, মুরগিপট্টি, কুমড়াপট্টি, বড় বাজার, মেরাজনগর, রইসনগর ও বালুমহালে দুটি নবনির্মিত অ্যাপার্টমেন্টের নিচে অবৈধ হাট থাকার খবর পাওয়া গেছে।
এদিকে মাংসের দোকানকে কেন্দ্র করে অনেকেই গরু কেনাবেচা করছেন। পান্থপথ, শুক্রাবাদ, কাঁঠালবাগান ও রাজাবাজারসহ বিভিন্ন এলাকায় মাংসের দোকানের সামনে গরু বেঁধে রাখতে দেখা গেছে। পান্থপথ এলাকার বাসিন্দা শাকিলা আক্তার জানান, আমার বাসার নিচে গত তিন দিন ধরে অন্তত ২০টি গরু রাখা হচ্ছে। দু-তিনটি করে নিয়ে সড়কে বেঁধে রাখে। সেগুলো বিক্রি করে পেছন থেকে আরও ২-৩টি নিয়ে আসে। অনেক সময় ক্রেতাদেরও নিয়ে আসে।