মেডিকেল ভর্তি পরীক্ষা- প্রেক্ষাপট বাংলাদেশ

Sanchoy Biswas
ডাঃ আশীষ কুমার চক্রবর্ত্তী
প্রকাশিত: ১১:০২ অপরাহ্ন, ১১ ডিসেম্বর ২০২৫ | আপডেট: ১১:৪৮ অপরাহ্ন, ১১ ডিসেম্বর ২০২৫
ছবিঃ সংগৃহীত
ছবিঃ সংগৃহীত

আগামী/আজ ১২ই ডিসেম্বর, শুক্রবার সারাদেশে একযোগে অনুষ্ঠিত হচ্ছে এমবিবিএস ভর্তি পরীক্ষা। স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের অধীনে স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিদপ্তর মেধা যাচাইয়ের এই গুরুত্বপূর্ণ পরীক্ষার আয়োজন করে, যা অত্যন্ত স্বচ্ছ ও সুশৃঙ্খল। এই প্রক্রিয়ার মাধ্যমে একজন প্রকৃত মেধাবী শিক্ষার্থী উচ্চমাধ্যমিকে ভালো ফলাফল অর্জন করে মেডিকেল ভর্তি পরীক্ষায় অংশগ্রহণের সুযোগ পায় এবং ভবিষ্যতে একজন চিকিৎসক হওয়ার স্বপ্ন দেখে।

সরকারি ও বেসরকারি সকল মেডিকেল কলেজে ভর্তির এই প্রক্রিয়া সারা দেশে একই দিনে, একই সময়ে এবং একই প্রশ্নপত্রে অনুষ্ঠিত হয়। মেডিকেল ভর্তি পরীক্ষা–২০২৫ নিয়েই আজকের এই লেখার সূচনা।

আরও পড়ুন: বাংলাদেশের বর্তমান শিক্ষা ব্যবস্থার মান: চ্যালেঞ্জ ও প্রয়োজনীয় সংস্কার এবং সেনাবাহিনীর অবদান

বর্তমানে সারাদেশে সরকারি, বেসরকারি ও আর্মড ফোর্সেস মিলিয়ে মোট ১১২টি মেডিকেল কলেজ রয়েছে, যেখানে মোট আসন সংখ্যা প্রায় ১২,১৮৯। এর মধ্যে সরকারি ৩৭টি মেডিকেল কলেজ, বেসরকারি ৬৮টি মেডিকেল কলেজ এবং আর্মড ফোর্সেস ৭টি মেডিকেল কলেজ রয়েছে। এ বছর এক লক্ষেরও বেশি শিক্ষার্থী এমবিবিএস ভর্তি পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করছে। মেধাগত মানদণ্ডে এদের অনেকেই মেডিকেলে পড়ার যোগ্য হলেও লিখিত পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয় আনুমানিক ৪০–৫০ হাজার শিক্ষার্থী।

লিখিত পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়া এই ৪০–৫০ হাজার শিক্ষার্থী প্রত্যেকেই এমবিবিএস কোর্সে ভর্তি হওয়ার যোগ্য। কিন্তু বাস্তবতা হলো—মাত্র ১১ হাজার শিক্ষার্থী চূড়ান্তভাবে মেডিকেলে ভর্তি হওয়ার সুযোগ পায়। ফলে লিখিত পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েও বাকি ৩০–৪০ হাজার শিক্ষার্থী চিকিৎসক হওয়ার স্বপ্ন থেকে বঞ্চিত হয়। এর মাধ্যমে স্পষ্ট হয় যে, শুধুমাত্র ভর্তি প্রতিযোগিতার কারণে অনেক প্রকৃত মেধাবী শিক্ষার্থী এমবিবিএসে ভর্তি হতে পারে না।

আরও পড়ুন: প্রাথমিক–মাধ্যমিকের শিক্ষকদের কর্মবিরতিতে স্থগিত বার্ষিক পরীক্ষা, বিপর্যস্ত শিক্ষাপঞ্জি

এই প্রক্রিয়ায় কোনোভাবেই অর্থ বা অন্য কোনো ধরনের প্রভাব খাটানোর সুযোগ নেই। একই প্রশ্নপত্রে ঢাকা মেডিকেল কলেজ থেকে শুরু করে ইউনিভার্সেল মেডিকেল কলেজ কিংবা ব্রাহ্মণবাড়িয়া মেডিকেল কলেজে সম্পূর্ণ মেধার ভিত্তিতে ভর্তি সম্পন্ন হয়। উল্লেখযোগ্য বিষয় হলো, সরকারি তত্ত্বাবধানে পরিচালিত এই ভর্তি প্রক্রিয়ায় বেসরকারি মেডিকেল কলেজ পরিচালনা পর্ষদের কোনো হস্তক্ষেপের সুযোগ নেই।

অতীতে এই প্রতিযোগিতামূলক প্রক্রিয়াকে আরও স্বচ্ছ করতে গত দুই–তিন বছর ধরে অটোমেশন সিস্টেম যুক্ত হয়েছে। ফলে একজন শিক্ষার্থী তার প্রাপ্ত নম্বর ও পছন্দক্রম অনুযায়ী কলেজ পায়—এখানে আর্থিক অবস্থার কোনো ভূমিকা নেই। এরপরও সাধারণ মানুষের মধ্যে এ বিষয়ে প্রচুর ভুল ধারণা বিদ্যমান।

বহু উচ্চপদস্থ ব্যক্তি আমাকে ফোন করে বলেন—তাদের সন্তান বা আত্মীয় উচ্চমাধ্যমিকে জিপিএ-৫ পেয়েছে এবং তারা চান তাদের সন্তান ডাক্তার হোক। তারা প্রায়শই জানতে চান, “কত টাকা লাগবে?” এ ধরনের প্রশ্ন শুনে বিব্রত বোধ করার পাশাপাশি দীর্ঘশ্বাস ফেলতে হয় এবং বলতে হয়—মেডিকেল ভর্তি সম্পূর্ণ জাতীয় মেধাভিত্তিক একটি প্রক্রিয়া। সরকারি ও বেসরকারি মেডিকেল কলেজে ভর্তির ক্রম সম্পূর্ণ মেধানুসারে নির্ধারিত হয় এবং ভর্তির খরচও সরকার নির্ধারিত।

অনেকে মনে করেন মেডিকেল শিক্ষার খরচ অত্যধিক। তবে তুলনামূলক পরিসংখ্যান দেখলে বোঝা যায়, ভারত ও নেপালের প্রাইভেট মেডিকেল কলেজে পড়াশোনা করে একজন চিকিৎসক হতে প্রায় এক কোটি টাকা বা তারও বেশি খরচ হয়। সেখানে বাংলাদেশে বিদেশি শিক্ষার্থীদের জন্য খরচ প্রায় অর্ধেক এবং দেশীয় শিক্ষার্থীদের জন্য তারও কম।

এছাড়া বাংলাদেশের মেডিকেল শিক্ষার মান অত্যন্ত উন্নত, ব্রিটিশ স্বীকৃতিপ্রাপ্ত এবং রোগীর বৈচিত্র্য ও সংখ্যার দিক থেকে বিশ্বে অন্যতম। গর্ব করার মতো বিষয় হলো—ভুটানের সাবেক প্রধানমন্ত্রী ডা. লোটে শেরিন ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজের প্রাক্তন শিক্ষার্থী। একইভাবে নেপালের খ্যাতনামা হৃদরোগ সার্জন ডা. ভগবান কৈরালা বাংলাদেশের জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউট (NICVD) থেকে এমএস ডিগ্রি অর্জন করে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাংলাদেশের সুনাম বৃদ্ধি করছেন।

তা সত্ত্বেও চিকিৎসক ও চিকিৎসা পেশার প্রতি নেতিবাচক মনোভাব, কুরুচিপূর্ণ মন্তব্য এবং হাসপাতালে চিকিৎসা কার্যক্রমে বাধা সৃষ্টির মতো অশুভ প্রবণতা এখনও বিদ্যমান। আমরা বিশ্বাস করি রাষ্ট্রের দৃঢ় অবস্থান এসব অপচেষ্টার অবসান ঘটাবে। এসব সমালোচনা মূলত অজ্ঞতা থেকেই উৎসারিত।

পরিশেষে বলতে চাই—এখনও বাবা-মায়েদের কাছে উচ্চশিক্ষার শীর্ষ পছন্দ মেডিকেল শিক্ষা। সামাজিক মর্যাদা, পেশাগত সম্মান ও জীবনের নিরাপত্তার কারণে চিকিৎসক পাত্র-পাত্রীরা আজও অগ্রাধিকার পায়। তবুও অজানা কারণে চিকিৎসকদের কর্মপরিবেশ ও সামাজিক মর্যাদা বারবার প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে।

তবে এত প্রতিকূলতার মাঝেও যারা ২০২৫–২৬ শিক্ষাবর্ষে মেধার ভিত্তিতে মেডিকেল ভর্তি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হবে—তাদের সকলকে জানাই আন্তরিক অভিনন্দন।

জয় হোক মেধাবীদের।

লেখক পরিচিতি

ডাঃ আশীষ কুমার চক্রবর্ত্তী

ব্যবস্থাপনা পরিচালক

ইউনিভার্সেল মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, ঢাকা

ইউনিভার্সেল মেডিকেল সার্ভিসেস লিমিটেড, ব্রাহ্মণবাড়িয়া